স্বৈরাচারী প্রবণতা থাকলে ভারতের নেতাদের ভোটাররা শাস্তি দিয়ে থাকেন
- সময় : ০৫:৫৯:৪৯ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২০ অগাস্ট ২০২৪
- / ১৬ বার দেখেছে
সুমিত গাঙ্গুলি: এ প্রশ্নের কিছু উত্তর মোদি সরকারের ভারতের অর্থনৈতিক বাস্তবতা বুঝতে না পারার মধ্যে লুকিয়ে আছে। মোদি সরকারের আমলে যথেষ্ট অর্থনৈতিক অগ্রগতি হয়েছে ঠিকই। কিন্তু সম্পদের বণ্টনে সমতা ছিল না। ভারতের গ্রাম ও শহরের মধ্যে অসাম্য ও বেকারত্ব বেড়েছে। ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণদের মধ্যে বেকারত্ব ৪৪ দশমিক ৪৯ শতাংশে পৌঁছেছে, যা দেশটির ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এটা সার্বিক জাতীয় পর্যায়ের পরিসংখ্যান। নির্দিষ্ট কোনো অঞ্চলের বেকারত্বের চিত্র এর চেয়ে ভয়াবহ হতে পারে। কিন্তু এই তথ্য-উপাত্ত থেকে তা আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব নয়।
এবারের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির ব্যর্থতার আরেকটি কারণ হলো, হিন্দু-মুসলিম ঐতিহাসিক উত্তেজনাকে মোদি বরাবরের মতো দলীয় স্বার্থে ব্যবহারের চেষ্টা করেছেন। যে কেউ ধর্মীয় দামামা বাজাতেই পারেন। মুসলিমদের ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলাসহ নানা ফাঁকা বুলি দিয়ে মোদি তা–ই করেছেন। কিন্তু দিন শেষে চাকরি ও আবাসনের মতো মানুষের দৈনন্দিন জীবনের বিষয়গুলো সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে।
আমার মতে, বিজেপি হিসাব কষতে একটি ভুল করেছে। যে দেশের শিশুদের মাত্র ১১ দশমিক ৩ শতাংশ পর্যাপ্ত পুষ্টি পায়, সেখানকার জনসাধারণকে হিন্দুত্বের মহিমার মতো বিষয় গেলানো যায় না। জনসাধারণের কাছে শেষ পর্যন্ত টমেটো ও অন্যান্য নিত্যপণ্যের মূল্যই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
সুমিত গাঙ্গুলি: বিজেপি দেশজুড়ে যে ভুল করেছে, এটা সেই ভুলেরই একটি উদাহরণ। রাজ্যের বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ নিজেকে কট্টরপন্থী হিন্দু জাতীয়তাবাদী নেতা মনে করেন। কিন্তু, তাঁর সরকারের নীতি রাজ্যের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে কী ধরনের প্রভাব ফেলছে, তা বুঝতে তিনিও ব্যর্থ হয়েছেন। রাজ্যের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বড় অংশ মুসলমান, যাদের অবস্থান ভারতের জাতপ্রথার একেবারে শেষ ধাপে।
যোগী আদিত্যনাথ নতুন মহাসড়ক ও বিমানবন্দর তৈরির মতো বিশাল বিশাল অবকাঠামো নির্মাণের প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। রাজ্যের মধ্যবিত্ত শ্রেণির কাছে এসব প্রকল্পের ভালো আবেদন থাকতে পারে। কিন্তু দরিদ্র জনগোষ্ঠীর এতে কোনো আগ্রহ নেই।
এর বাইরে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা যোগী সরকার ভিন্নমতের মানুষকে দমন করতে পুলিশকে ব্যবহার করেছে। ভিন্নমতের এসব মানুষের সিংহভাগই দরিদ্র ও প্রান্তিক। যোগী এসব জনগোষ্ঠীর সমর্থন হারিয়েছেন।
সুমিত গাঙ্গুলি: দক্ষিণে বিজেপির জয়লাভের বিষয়টি কিছুটা হতবুদ্ধ হওয়ার মতো বিষয়। বিষয়টিকে নির্ভুলভাবে ব্যাখ্যা করতে হলে ভোটের ধরন নিয়ে আরও তথ্য দরকার।
দক্ষিণের রাজ্যগুলোয় বিজেপি হানা দিতে না পারার পেছনে ঐতিহাসিক বেশ কিছু কারণ রয়েছে। ভাষাগত উপজাতীয়তাবাদ এসব কারণের একটি, যা হিন্দির প্রতি বৈরীভাবাপন্ন।
অন্যান্য কারণের মধ্যে রয়েছে দক্ষিণে হিন্দুধর্মচর্চার ভিন্নতা। এখানে নানা পার্বণ ও আঞ্চলিক প্রথা আলাদা। কিন্তু বিজেপির হিন্দুত্ববাদের ধারণা, উত্তর ভারতের ‘মহান প্রথা’কে ভিত্তি করে হিন্দুধর্ম গড়ে উঠেছে, যা ব্রহ্ম, বিষ্ণু ও শিবের ত্রিদেবত্বে বিশ্বাসী। তাঁরা যথাক্রমে সৃষ্টি, রক্ষা ও প্রলয়ের দেবতা।
দক্ষিণের আরেকটি বিষয় হলো, এই অঞ্চলের রাজ্যগুলো ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল উৎস। এসব রাজ্য থেকে উত্তরের বিভিন্ন দরিদ্র রাজ্যকে ভর্তুকি দেওয়া নিয়ে ব্যাপক অসন্তোষ রয়েছে। এসব নিয়ে বিজেপির রাজনৈতিক ঘাঁটি শক্ত হলেও উত্তর ভারতে দলটির বিরুদ্ধে অসন্তোষ বেড়েছে।
সুমিত গাঙ্গুলি: না, নির্বাচনী খেলার মাঠ সমান ছিল না। গণমাধ্যম অধিকাংশ ক্ষেত্রে অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে শাসক দল বিজেপির হয়ে কাজ করেছে। দু-একটি আঞ্চলিক সংবাদপত্রের কথা বাদ দিলে বাকি সব জাতীয় দৈনিক লক্ষণীয়ভাবে বিজেপির সমালোচনা এড়িয়ে গেছে। আর প্রথম সারির টেলিভিশন চ্যানেলগুলো প্রায় সব ক্ষেত্রে সরকারের নীতির উৎসাহী সমর্থক (চিয়ারলিডার) হিসেবে কাজ করেছে।
বেশ কিছু গোয়েন্দা সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাদের নির্লজ্জভাবে দলীয় স্বার্থে বিরোধী দলগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছে। বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের এমন সব অভিযোগে কারাগারে পাঠানো হয়েছে, যা স্পষ্টত সন্দেহজনক। উদাহরণ হিসেবে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের কথা বলা যায়। তাঁর বিরুদ্ধে আবগারি শুল্ক নীতি নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ আনা হয়েছে। লোকসভা নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার কয়েক দিন পরই তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
সুমিত গাঙ্গুলি: বিজেপি দেশজুড়ে একটি পোক্ত সাংগঠনিক ভিত্তি তৈরি করেছে, যা প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের নেই। অন্যদিকে ১৯৭০-এর দশকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দেশে জরুরি অবস্থা জারির পর কংগ্রেসের রাজনৈতিক ভিত্তিমূলে যে ক্ষত হয়েছিল, তা উপশম করতে দলটি বলতে গেলে তেমন কিছুই করেনি। এমন একটি পরিস্থিতিতে (১৯৭৭ সালে) কংগ্রেস ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়ে। অন্যান্য দল প্রথমবারের মতো জোটে সরকার গঠন করে।
এ ছাড়া বিজেপি এমন সব স্লোগানের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু জনগোষ্ঠীর আবেগকে কাজে লাগিয়েছে, যাতে ভারতের প্রধান সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠীকে অজস্র সমস্যার উৎস হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। গত কয়েক বছরে ভারতজুড়ে মুসলিম ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ঘৃণাজনিত অপরাধ বেড়েছে।
যা না বললেই নয়, ১৯৯০-এর দশক থেকে কংগ্রেস সরকার যেসব অর্থনৈতিক সংস্কারের উদ্যোগ শুরু করেছিল, বিজেপি সেগুলো থেকে লাভবান হয়েছে। এসব উদ্যোগের মধ্যে পণ্য ও সেবা কর (জিএসটি), লোকসানি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এয়ারলাইনস এয়ার ইন্ডিয়া বেসরকারীকরণ অন্যতম। এসব পদক্ষেপ ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়নে যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছে।
সুমিত গাঙ্গুলি: এটা নিশ্চিত যে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করায় হিন্দু ভোটারদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ উজ্জীবিত হয়েছিল। বিজেপির সমর্থন বাড়তে এটি সহায়তা করেছিল। এ ঘটনার মাত্র সাত বছর পর ১৯৯৯ সালে বিজেপি প্রথমবারের মতো জোট সরকার গড়ে ক্ষমতায় আসে। তখন লোকসভার ৫৪৩ আসনের মধ্যে বিজেপি পেয়েছিল ১৮২টি। পরবর্তী দুটি লোকসভা নির্বাচনের পর ২০১৪ সালে ২৮২ আসন জিতে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী হন মোদি।
এবারের লোকসভা নির্বাচনের কয়েক মাস আগে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের স্থানে নবনির্মিত রামমন্দির উদ্বোধন করেন মোদি। আসন্ন ভোটের কথা মাথায় রেখে সতর্কতার সঙ্গে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠান করা হয়েছিল।
যা–ই হোক, সেই অযোধ্যায় এবার বিজেপি হেরেছে। সেখানে বিজেপির পরাজয়ের কারণ সম্ভবত এই যে, রামমন্দিরের উদ্বোধন ঘিরে যে উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়েছিল, তা অযোধ্যার বাইরের মানুষের কাছেই আবেদন তৈরি করেছিল, শহরের বাসিন্দাদের কাছে নয়। বরং শহরের বাসিন্দারা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও অন্যান্য সমস্যা নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন।
সুমিত গাঙ্গুলি: মোদি জোটের অংশীদারদের নিয়ে সরকার গঠন করবেন, এটা অনেকটা নিশ্চিত। আমার বিশ্বাস, বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ হিসেবে এবারের ধাক্কা থেকে শিক্ষা নেবেন মোদি এবং সেই অনুযায়ী তাঁর নতুন কৌশল সাজাবেন।
এবারের ফলাফল সবার জন্য একটি কার্যকর সংশোধনী বার্তা। ভারতের ভোটাররা আবারও এটাই প্রমাণ করলেন যে তিনি নারী বা পুরুষ যেই হোন, কিছু জিনিস চাইলে তাঁরা করতে পারেন, যা অন্য কেউ করতে পারেন না।
অতীতেও গণতন্ত্র যখন হুমকিতে পড়েছে, তখনো ভারতের ভোটাররা তাঁদের শক্তি দেখিয়েছেন। স্বৈরাচারী প্রবণতা রয়েছে এমন নেতাদের তাঁরা শাস্তি দিয়ে থাকেন। ১৯৭৭ সালের নির্বাচনে আমরা প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে করুণভাবে হারতে দেখেছি। এই নির্বাচনের আগে তিনি দেশজুড়ে জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন। সব ধরনের নাগরিক স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছিলেন। তখন ভারতের গরিবেরাই ভোট দিয়ে তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন।
এবারের নির্বাচনে সুনির্দিষ্টভাবে কোন বর্ণ ও পেশার মানুষ (কোন রাজ্যে কাকে) কীভাবে ভোট দিয়েছেন, সে বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য পেতে আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে।