০৭:৩০ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

এই অসম্মানের দায় কার…

রিপোর্টার
  • সময় : ১০:২৮:৪১ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২০ অগাস্ট ২০২৪
  • / ২১ বার দেখেছে

১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর সরকারি রেডিও-টেলিভিশনে তাঁর ভাষণ প্রচার তো দূরে থাক, নাম উচ্চারণেও অলিখিত নিষেধাজ্ঞা ছিল।

বর্তমান সময়ের মতো এতো বেসরকারি রেডিও-টিভি চ্যানেল বা সংবাদমাধ্যমও তখন ছিল না। দীর্ঘ দুই দশক পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে তখনকার তরুণ প্রজন্ম প্রথমবারের মতো রেডিও-টিভিতে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের সচিত্র ভাষণটি শুনে রীতিমতো উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছিল। ইতিহাসকে অবরুদ্ধ করে রাখতে চাইলে তার প্রতি আগ্রহ ও কৌতূহল যে প্রবল হয়ে ওঠে এই প্রতিক্রিয়া তার প্রমাণ।

পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে এদেশে যখন বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করা যেতো না, তখন কবি ও শিল্পীরা কবিতা-গান ও চিত্রকলার মাধ্যমে তাঁকে স্মরণ করেছেন। কবি নির্মলেন্দু গুণ ১৯৭৭ সালে এক কবিতাসভায় সমস্ত ভয় উপেক্ষা করে ‘আজ আমি কারো রক্ত চাইতে আসিনি’ কবিতাটি পাঠ করেছিলেন, ‘সমবেত সকলের মতো আমিও পলাশ ফুল ভালোবাসি/সমকাল পার হয়ে যেতে সদ্যফোটা একটি পলাশ গতকাল কানে কানে/আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।’

কবি রফিক আজাদ লিখেছিলেন, ‘এই সিঁড়ি নেমে গেছে বঙ্গোপসাগরে/সিঁড়ি ভেঙে নেমে গেছে…/বত্রিশ নম্বর থেকে/সবুজ শস্যের মাঠ বেয়ে/অমল রক্তের ধারা বয়ে গেছে বঙ্গোপসাগরে…।’

এ রকম আরও অনেক গান-কবিতা রচিত হয়েছিল তখন। শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ বঙ্গবন্ধুর বেশ কিছু ছবি এঁকেছিলেন। তাঁর আঁকা ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ির সিঁড়িতে ঘাতকের গুলিতে মুখ থুব্ড়ে পড়ে থাকা বঙ্গবন্ধুর তৈলচিত্রটি শিল্প ও ইতিহাস উভয় বিচারেই অবিস্মরণীয়।

সম্প্রতি ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনার পতনের পর দেশজুড়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙার যে উত্সবে মেতেছে কিছু অপরিণামদর্শী মানুষ, ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে আগুন দিয়ে যেভাবে ধ্বংস করা হয়েছে একটি দেশ ও জাতির গৌরব-বেদনার স্মৃতি ও ঐতিহাসিক দলিল, তা রীতিমতো নজিরবিহীন।

বলা হচ্ছে, প্রচণ্ড ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ এসব কর্মযজ্ঞ। কিন্তু সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সরকারের স্বেচ্ছাচারিতা, দুর্নীতি, অনিয়ম, অবিচার ও দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে একটি সফল আন্দোলনের পর দেশজুড়ে যে অরাজকতা সৃষ্টির চেষ্টা, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ওপর যে আক্রমণ, তা কি আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের কাম্য ছিল?

মনে হয় না। বরং এতে মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত শক্তির ইন্ধন আছে বলে ভাবার যথেষ্ট যুক্তি আছে। তবে এর পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের ‘ধারক–বাহক’ বলে পরিচয়দানকারী আওয়ামী লীগ নেতৃত্বেরও এতে দায় আছে কি না, ভাবার সময় এসেছে।

২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে নির্বাচনের নামে যে প্রহসন হয়েছে, সেই বঞ্চনার বিপরীতে উন্নয়নের গল্প যেমন আকৃষ্ট করেনি তাঁদের, তেমনি বঙ্গবন্ধুর ভাষণের একঘেয়ে পুনরাবৃত্তি বা যত্রতত্র নির্মিত বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যও সমীহ জাগায়নি তাঁদের মনে। সব ক্ষেত্রেই চাটুকার পরিবেষ্টিত হয়ে পড়েছিল এই সরকারের নীতিনির্ধারকেরা। মুজিব বর্ষ উপলক্ষে শত শত বই প্রকাশের হিড়িক পড়ে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এত বইপত্র ও গবেষণা যে শেষ পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের কোনোভাবেই প্রভাবিত বা অনুপ্রাণিত করেনি, সেটা তো সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে প্রমাণিত।

১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর নামে রাস্তাঘাট, হাটবাজার, সেতু, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল—নানা কিছুর নামকরণ করেছে। রেডিও-টেলিভিশনের মতো রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যম প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে বঙ্গবন্ধুকে উপস্থাপন করেছে, দলীয় প্রচারণার কেন্দ্রে পরিণত করেছে এই প্রতিষ্ঠানকে।

নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের পর এরশাদের বিদায়ের ঘটনা থেকেও আওয়ামী লীগ বড় কোনো শিক্ষা নিয়েছে বলে মনে হয় না। সরকারিভাবে বঙ্গবন্ধুর মহত্ত্ব, মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগের দলীয় কৃতিত্বকে যত বেশি জাহির করা হয়েছে, ততই এসব বিষয় সম্পর্কে সাধারণ মানুষের সশ্রদ্ধ অভিব্যক্তি ক্রমে বিরাগ ও বিতৃষ্ণায় রূপান্তরিত হয়েছে।

আরও প্রায় আট বছর ক্ষমতার বাইরে থাকার পর বিএনপির অপশাসনের পথ বেয়ে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আবার বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ফিরে এলে অনেকেই ধারণা করেছিলেন, আওয়ামী লীগের মধ্যে এবার আত্মশুদ্ধির আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পাবে। কিন্তু সেটা তো পেলই না, বরং পরবর্তী তিনটি প্রকৃত প্রতিদ্বন্দ্বীহীন নির্বাচনে জিতে তাদের দম্ভ-অহমিকা আগের সব রেকর্ড ভেঙেছে। সমাজের সর্বস্তরের মানুষ নানাভাবে অপমানিত ও লাঞ্ছিত হয়েছে আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতা থেকে শুরু করে পাড়া-মহল্লার সাধারণ কর্মীদের দ্বারা।

আরও পড়ুন

এ সময়ে আওয়ামী লীগ প্রচুর উন্নয়নকাজ করে ভেবেছে অধিকারের প্রশ্ন না তুলে জনগণের উচিত এই উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য দল ও সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা। অথচ এসব উন্নয়নকাজের বিভিন্ন প্রকল্পে বিরাট  দুর্নীতির সঙ্গে মন্ত্রী, এমপি বা অনুগ্রহভাজন লোকজনের সম্পৃক্ত থাকার খবর তখন সংবাদমাধ্যমের অনুসন্ধানে বেরোতে শুরু করেছে।

এ রকম একটি সময়ে ভূ-উপগ্রহ বা নদীর তলদেশে টানেলের সঙ্গে নাম যুক্ত করে বঙ্গবন্ধুকে যতই মহিমা দেওয়ার চেষ্টা হোক না কেন, প্রকারান্তরে তা পুরো জাতির পরিবর্তে তাঁকে একটি দলের নেতা হিসেবেই প্রতিষ্ঠা দিয়েছে।

এ সময় কারণে-অকারণে থানা-ইউনিয়ন পর্যায়ের দলীয় কার্যালয় থেকে শুরু করে চায়ের দোকানে পর্যন্ত মাইকে বাজানো হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। এই অত্যুত্সাহীদের কারণে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ১০টি ভাষণের একটি হিসেবে বিবেচিত, আব্রাহাম লিংকন, উইনস্টন চার্চিল বা নেলসন ম্যান্ডেলার পাশে স্থান পাওয়া ভাষণটি (জ্যাকব এফ ফিল্ড সম্পাদিত উই শ্যাল ফাইট অন দ্য বিচেস-দ্য স্পিচেস দ্যাট ইনস্পায়ার্ড হিস্ট্রি) বহু ব্যবহারে জীর্ণ হয়েছে।

শুরুতেই বলেছি, দীর্ঘকাল পর ১৯৯৬ সালে রেডিও-টেলিভিশনে প্রচারিত হওয়ার পর এ ভাষণ তরুণদের উদ্দীপ্ত করেছিল। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে এখন যাঁদের ১৮-২৫ বছর বয়স, তাঁদের একটি বড় অংশ জীবনে জাতীয় নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগ বা নিজেদের প্রার্থী পছন্দের সুযোগ পাননি। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে নির্বাচনের নামে যে প্রহসন হয়েছে, সেই বঞ্চনার বিপরীতে উন্নয়নের গল্প যেমন আকৃষ্ট করেনি তাঁদের, তেমনি বঙ্গবন্ধুর ভাষণের একঘেয়ে পুনরাবৃত্তি বা যত্রতত্র নির্মিত বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যও সমীহ জাগায়নি তাঁদের মনে।

সব ক্ষেত্রেই চাটুকার পরিবেষ্টিত হয়ে পড়েছিল এই সরকারের নীতিনির্ধারকেরা। মুজিব বর্ষ উপলক্ষে শত শত বই প্রকাশের হিড়িক পড়ে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এত বইপত্র ও গবেষণা যে শেষ পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের কোনোভাবেই প্রভাবিত বা অনুপ্রাণিত করেনি, সেটা তো সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে প্রমাণিত।

১৫ আগস্ট ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে শ্রদ্ধা জানাতে আসা লোকজনের প্রতি কিছু উচ্ছৃঙ্খল ব্যক্তির যেসব আচরণ পত্রপত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তা দেখে সাধারণ মানুষ যুগপৎ বিস্মিত ও ব্যথিত। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘এগুলো আইনসংগত নয়। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে যা করা প্রয়োজন, একটি প্রেশার গ্রুপ হিসেবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তা করবে।’ এ বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্ত করে দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা না নিলে সারা দেশে উচ্ছৃঙ্খলা ক্রমে বাড়তে পারে।

ট্যাগ :

শেয়ার করুন

এই অসম্মানের দায় কার…

সময় : ১০:২৮:৪১ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২০ অগাস্ট ২০২৪

১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর সরকারি রেডিও-টেলিভিশনে তাঁর ভাষণ প্রচার তো দূরে থাক, নাম উচ্চারণেও অলিখিত নিষেধাজ্ঞা ছিল।

বর্তমান সময়ের মতো এতো বেসরকারি রেডিও-টিভি চ্যানেল বা সংবাদমাধ্যমও তখন ছিল না। দীর্ঘ দুই দশক পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে তখনকার তরুণ প্রজন্ম প্রথমবারের মতো রেডিও-টিভিতে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের সচিত্র ভাষণটি শুনে রীতিমতো উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছিল। ইতিহাসকে অবরুদ্ধ করে রাখতে চাইলে তার প্রতি আগ্রহ ও কৌতূহল যে প্রবল হয়ে ওঠে এই প্রতিক্রিয়া তার প্রমাণ।

পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে এদেশে যখন বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করা যেতো না, তখন কবি ও শিল্পীরা কবিতা-গান ও চিত্রকলার মাধ্যমে তাঁকে স্মরণ করেছেন। কবি নির্মলেন্দু গুণ ১৯৭৭ সালে এক কবিতাসভায় সমস্ত ভয় উপেক্ষা করে ‘আজ আমি কারো রক্ত চাইতে আসিনি’ কবিতাটি পাঠ করেছিলেন, ‘সমবেত সকলের মতো আমিও পলাশ ফুল ভালোবাসি/সমকাল পার হয়ে যেতে সদ্যফোটা একটি পলাশ গতকাল কানে কানে/আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।’

কবি রফিক আজাদ লিখেছিলেন, ‘এই সিঁড়ি নেমে গেছে বঙ্গোপসাগরে/সিঁড়ি ভেঙে নেমে গেছে…/বত্রিশ নম্বর থেকে/সবুজ শস্যের মাঠ বেয়ে/অমল রক্তের ধারা বয়ে গেছে বঙ্গোপসাগরে…।’

এ রকম আরও অনেক গান-কবিতা রচিত হয়েছিল তখন। শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ বঙ্গবন্ধুর বেশ কিছু ছবি এঁকেছিলেন। তাঁর আঁকা ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ির সিঁড়িতে ঘাতকের গুলিতে মুখ থুব্ড়ে পড়ে থাকা বঙ্গবন্ধুর তৈলচিত্রটি শিল্প ও ইতিহাস উভয় বিচারেই অবিস্মরণীয়।

সম্প্রতি ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনার পতনের পর দেশজুড়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙার যে উত্সবে মেতেছে কিছু অপরিণামদর্শী মানুষ, ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে আগুন দিয়ে যেভাবে ধ্বংস করা হয়েছে একটি দেশ ও জাতির গৌরব-বেদনার স্মৃতি ও ঐতিহাসিক দলিল, তা রীতিমতো নজিরবিহীন।

বলা হচ্ছে, প্রচণ্ড ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ এসব কর্মযজ্ঞ। কিন্তু সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সরকারের স্বেচ্ছাচারিতা, দুর্নীতি, অনিয়ম, অবিচার ও দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে একটি সফল আন্দোলনের পর দেশজুড়ে যে অরাজকতা সৃষ্টির চেষ্টা, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ওপর যে আক্রমণ, তা কি আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের কাম্য ছিল?

মনে হয় না। বরং এতে মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত শক্তির ইন্ধন আছে বলে ভাবার যথেষ্ট যুক্তি আছে। তবে এর পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের ‘ধারক–বাহক’ বলে পরিচয়দানকারী আওয়ামী লীগ নেতৃত্বেরও এতে দায় আছে কি না, ভাবার সময় এসেছে।

২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে নির্বাচনের নামে যে প্রহসন হয়েছে, সেই বঞ্চনার বিপরীতে উন্নয়নের গল্প যেমন আকৃষ্ট করেনি তাঁদের, তেমনি বঙ্গবন্ধুর ভাষণের একঘেয়ে পুনরাবৃত্তি বা যত্রতত্র নির্মিত বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যও সমীহ জাগায়নি তাঁদের মনে। সব ক্ষেত্রেই চাটুকার পরিবেষ্টিত হয়ে পড়েছিল এই সরকারের নীতিনির্ধারকেরা। মুজিব বর্ষ উপলক্ষে শত শত বই প্রকাশের হিড়িক পড়ে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এত বইপত্র ও গবেষণা যে শেষ পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের কোনোভাবেই প্রভাবিত বা অনুপ্রাণিত করেনি, সেটা তো সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে প্রমাণিত।

১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর নামে রাস্তাঘাট, হাটবাজার, সেতু, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল—নানা কিছুর নামকরণ করেছে। রেডিও-টেলিভিশনের মতো রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যম প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে বঙ্গবন্ধুকে উপস্থাপন করেছে, দলীয় প্রচারণার কেন্দ্রে পরিণত করেছে এই প্রতিষ্ঠানকে।

নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের পর এরশাদের বিদায়ের ঘটনা থেকেও আওয়ামী লীগ বড় কোনো শিক্ষা নিয়েছে বলে মনে হয় না। সরকারিভাবে বঙ্গবন্ধুর মহত্ত্ব, মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগের দলীয় কৃতিত্বকে যত বেশি জাহির করা হয়েছে, ততই এসব বিষয় সম্পর্কে সাধারণ মানুষের সশ্রদ্ধ অভিব্যক্তি ক্রমে বিরাগ ও বিতৃষ্ণায় রূপান্তরিত হয়েছে।

আরও প্রায় আট বছর ক্ষমতার বাইরে থাকার পর বিএনপির অপশাসনের পথ বেয়ে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আবার বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ফিরে এলে অনেকেই ধারণা করেছিলেন, আওয়ামী লীগের মধ্যে এবার আত্মশুদ্ধির আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পাবে। কিন্তু সেটা তো পেলই না, বরং পরবর্তী তিনটি প্রকৃত প্রতিদ্বন্দ্বীহীন নির্বাচনে জিতে তাদের দম্ভ-অহমিকা আগের সব রেকর্ড ভেঙেছে। সমাজের সর্বস্তরের মানুষ নানাভাবে অপমানিত ও লাঞ্ছিত হয়েছে আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতা থেকে শুরু করে পাড়া-মহল্লার সাধারণ কর্মীদের দ্বারা।

আরও পড়ুন

এ সময়ে আওয়ামী লীগ প্রচুর উন্নয়নকাজ করে ভেবেছে অধিকারের প্রশ্ন না তুলে জনগণের উচিত এই উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য দল ও সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা। অথচ এসব উন্নয়নকাজের বিভিন্ন প্রকল্পে বিরাট  দুর্নীতির সঙ্গে মন্ত্রী, এমপি বা অনুগ্রহভাজন লোকজনের সম্পৃক্ত থাকার খবর তখন সংবাদমাধ্যমের অনুসন্ধানে বেরোতে শুরু করেছে।

এ রকম একটি সময়ে ভূ-উপগ্রহ বা নদীর তলদেশে টানেলের সঙ্গে নাম যুক্ত করে বঙ্গবন্ধুকে যতই মহিমা দেওয়ার চেষ্টা হোক না কেন, প্রকারান্তরে তা পুরো জাতির পরিবর্তে তাঁকে একটি দলের নেতা হিসেবেই প্রতিষ্ঠা দিয়েছে।

এ সময় কারণে-অকারণে থানা-ইউনিয়ন পর্যায়ের দলীয় কার্যালয় থেকে শুরু করে চায়ের দোকানে পর্যন্ত মাইকে বাজানো হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। এই অত্যুত্সাহীদের কারণে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ১০টি ভাষণের একটি হিসেবে বিবেচিত, আব্রাহাম লিংকন, উইনস্টন চার্চিল বা নেলসন ম্যান্ডেলার পাশে স্থান পাওয়া ভাষণটি (জ্যাকব এফ ফিল্ড সম্পাদিত উই শ্যাল ফাইট অন দ্য বিচেস-দ্য স্পিচেস দ্যাট ইনস্পায়ার্ড হিস্ট্রি) বহু ব্যবহারে জীর্ণ হয়েছে।

শুরুতেই বলেছি, দীর্ঘকাল পর ১৯৯৬ সালে রেডিও-টেলিভিশনে প্রচারিত হওয়ার পর এ ভাষণ তরুণদের উদ্দীপ্ত করেছিল। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে এখন যাঁদের ১৮-২৫ বছর বয়স, তাঁদের একটি বড় অংশ জীবনে জাতীয় নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগ বা নিজেদের প্রার্থী পছন্দের সুযোগ পাননি। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে নির্বাচনের নামে যে প্রহসন হয়েছে, সেই বঞ্চনার বিপরীতে উন্নয়নের গল্প যেমন আকৃষ্ট করেনি তাঁদের, তেমনি বঙ্গবন্ধুর ভাষণের একঘেয়ে পুনরাবৃত্তি বা যত্রতত্র নির্মিত বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যও সমীহ জাগায়নি তাঁদের মনে।

সব ক্ষেত্রেই চাটুকার পরিবেষ্টিত হয়ে পড়েছিল এই সরকারের নীতিনির্ধারকেরা। মুজিব বর্ষ উপলক্ষে শত শত বই প্রকাশের হিড়িক পড়ে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এত বইপত্র ও গবেষণা যে শেষ পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের কোনোভাবেই প্রভাবিত বা অনুপ্রাণিত করেনি, সেটা তো সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে প্রমাণিত।

১৫ আগস্ট ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে শ্রদ্ধা জানাতে আসা লোকজনের প্রতি কিছু উচ্ছৃঙ্খল ব্যক্তির যেসব আচরণ পত্রপত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তা দেখে সাধারণ মানুষ যুগপৎ বিস্মিত ও ব্যথিত। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘এগুলো আইনসংগত নয়। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে যা করা প্রয়োজন, একটি প্রেশার গ্রুপ হিসেবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তা করবে।’ এ বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্ত করে দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা না নিলে সারা দেশে উচ্ছৃঙ্খলা ক্রমে বাড়তে পারে।