১০:৩৩ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শ্রম অভিবাসন থেকে অব্যবস্থাপনা নিরসনে কিছু প্রস্তাব

রিপোর্টার
  • সময় : ১০:২৭:৫৭ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২০ অগাস্ট ২০২৪
  • / ১৮ বার দেখেছে

ছাত্র-জনতার সফল গণ–অভ্যুত্থানের পর ৮ আগস্ট বিশ্বজনবিদিত প্রফেসর ড. মুহম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। এই অন্তর্বর্তী সরকার দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ব্যাপক সমর্থন ইতিমধ্যে লাভ করেছে।

এ সরকারের কাছে মানুষের, বিশেষ করে আন্দোলনকারী ছাত্র–জনগোষ্ঠীর প্রত্যাশাও ব্যাপক। শুধু নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচন পরিচালনা করাকে এই সরকারের কাজ বলে মনে করছেন না কেউই। নির্বাচনের পূর্বে পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে প্রয়োজন রাজনৈতিক ব্যবস্থার কাঠামোগত, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও আরও বহু ক্ষেত্রে সংস্কার।

১৯৯৫ সাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা, নীতি পরিবর্তন ও মাঠপর্যায়ে অভিবাসীদের সেবা দানকারী প্রতিষ্ঠান রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট (রামরু) অভিবাসী কর্মীদের অধিকার আদায়ের জন্য বিভিন্ন রকম নীতিপরামর্শ প্রদান করে আসছে। প্রতিষ্ঠানটির সৌভাগ্য হয়েছে সরকারের বিভিন্ন নীতির খসড়া প্রণয়নে নেতৃত্ব দানে। বিগত সরকারগুলো এর কিছু কিছু বাস্তবায়ন করলেও অভিবাসীদের অধিকারের বিষয়টি সব সময়ই অবহেলিত রয়ে গেছে।

রামরুর গবেষণায় দেখা যায়, উনিশ শতাংশ অভিবাসী আংশিক অথবা সম্পূর্ণ অভিবাসন ব্যয় নির্বাহ করেও বিদেশে যেতে পারেননি। আরও ৩১ ভাগ বিদেশে যাওয়ার পর নানা রকম হয়রানির শিকার হয়েছেন। কেউ কেউ কাজ ও বেতন না পেয়ে অল্প সময়ের ভেতর ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন, কেউবা শারীরিক ও মানসিক নিগ্রহ সহ্য করেছেন। নারী শ্রমিকদের একাংশ অন্যান্য প্রতারণার পাশাপাশি যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন, এমনকি লাশ হয়েও ফিরেছেন অনেকে।

অভিবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতির চালিকা শক্তি হলেও এর ব্যবস্থাপনায় এখনো রয়েছে ঘাটতি। কোভিড-১৯–এর পরে প্রত্যাবর্তিত অভিবাসীদের পুনর্বাসনের বিষয়টি বিবেচনার জন্য জোর দাবি উঠেছে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে।

এবারের গণ–অভ্যুত্থানে রেমিট্যান্স পাঠানো বন্ধ করে অভিবাসীরা সরাসরি অংশগ্রহণ করেছেন। তাঁদের এই অবদানকে মূল্যায়ন করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে খুব দ্রুত কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। রামরুর দীর্ঘদিনের কর্ম অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আগামীতে অভিবাসনে সুশাসন আনতে হলে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন, তা নিম্নে উপস্থাপন করা হলো—

দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্পমেয়াদি অভিবাসী বাংলাদেশি নাগরিকেরা দীর্ঘদিন ধরে ভোট প্রদানের সুযোগ চাচ্ছেন। নির্বাচন কমিশন বিভিন্ন সময় এটি নিয়ে আলোচনা করলেও এর বাস্তবায়ন করেনি। অভিবাসী বাংলাদেশি কর্মীদের সাধারণ নির্বাচনে ভোটদানের সুযোগ অনুসন্ধানের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

১. ২০০১ সালে তদানীন্তন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সৃষ্টি করা ‘ন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজি অন স্ট্রিমলাইনিং লেবার রিক্রুটমেন্ট ২০০১’- এর আলোকে নতুন নির্বাচিত সরকার অভিবাসীদের জন্য প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সৃষ্টি করেছিল। ২০০৯ সাল নাগাদ অভিবাসনকে অর্থনীতির ‘থ্রাস্ট সেক্টর’ হিসেবে ঘোষণা করা হলেও এই মন্ত্রণালয়ের বাজেট অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের তুলনায় সর্বনিম্ন পর্যায়ে থেকে গেছে।

দীর্ঘদিন ধরে রাজস্ব বাজেটের ন্যূনতম ১ শতাংশ এই খাতে বরাদ্দ করা অথবা প্রতিবছর যে পরিমাণ রেমিট্যান্স দেশে আসে, তার ৫ শতাংশ সমমানের বরাদ্দ কর্মী ও তাঁর পরিবারের অধিকার রক্ষা ও সেবায় ব্যয় করার দাবি জানিয়ে আসছে নাগরিক সমাজের প্রতিষ্ঠানগুলো। আমরা আশা করব, অন্তর্বর্তী সরকার এই ন্যায্য দাবির প্রতি দৃষ্টিপাত করবে।

২. দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্পমেয়াদি অভিবাসী বাংলাদেশি নাগরিকেরা দীর্ঘদিন ধরে ভোট প্রদানের সুযোগ চাচ্ছেন। নির্বাচন কমিশন বিভিন্ন সময় এটি নিয়ে আলোচনা করলেও এর বাস্তবায়ন করেনি। অভিবাসী বাংলাদেশি কর্মীদের সাধারণ নির্বাচনে ভোটদানের সুযোগ অনুসন্ধানের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

৩. নারী অভিবাসন থেকে আধুনিক দাসত্ব বন্ধ করে নিরাপদ কর্মসংস্থানের সুযোগ খোঁজা, নির্যাতিত ও কর্মচ্যুত নারী অভিবাসীদের আইনি সহায়তা, মনোসামাজিক সেবা, অভিবাসনের দেশে সেফ হোম সৃষ্টি, যৌন নির্যাতনের কারণে জন্ম নেওয়া শিশুর রক্ষণাবেক্ষণসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

৪. ন্যায়সংগত ও নৈতিক নিয়োগ নিশ্চিত করার জন্য অভিবাসন প্রক্রিয়াকরণকে সিন্ডিকেটমুক্ত করা প্রয়োজন। ব্যক্তিগতভাবে সংগৃহীত ভিসা, রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে প্রক্রিয়াকরণের নিয়মটি বন্ধ করে ডেমো অফিসগগুলোকে শক্তিশালী করা দরকার। ভালো মানের কোম্পানি ভিসা সংগ্রহে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে বাধ্য করা, সাব-এজেন্টদের অনানুষ্ঠানিক সেবাগুলোকে আনুষ্ঠানিক কাজের অংশে পরিণত করা আবশ্যক।

৫. প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় একটি বিশেষায়িত মন্ত্রণালয়। আমলাতন্ত্রের সাধারণ বদলির নিয়মের ভেতর মন্ত্রণালয়টি চলে বলে অভিবাসন বিষয়ে যাঁরা দক্ষতা অর্জন করেন, কয়েক বছরের মাথায় তাঁরা অন্য মন্ত্রণালয়ে চলে যান। পরবর্তী কর্মকর্তাকে আবার নতুন করে সব শিখতে হয়। এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালনের জন্য ‘ক্যাডার সার্ভিস’ চালু করা প্রয়োজন।

৬. অভিবাসন ব্যবস্থাপনায় প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেমন বিএমইটি, ডেমো, টিটিসি, বোয়েসেল, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক ইত্যাদির প্রাতিষ্ঠানিক কর্মদক্ষতার মূল্যায়ন করে এগুলোকে শক্তিশালী করার নীতিমালা তৈরি করা।

৭. জাতীয় দক্ষতা নীতিতে আন্তর্জাতিক অভিবাসীদের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হয়নি। প্রতিযোগিতামূলক আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী জনবল সৃষ্টির জন্য দক্ষতা বৃদ্ধিবিষয়ক কর্মপরিকল্পনা ও বাজেট বরাদ্দ করা প্রয়োজন।

৮. কয়েক বছর ধরেই বিভিন্ন কারণে আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায় রেমিট্যান্স হ্রাস পাচ্ছে, নতুবা এর প্রবৃদ্ধির হার কমছে। মুদ্রাস্ফীতি, আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক প্রবাহে এক্সচেঞ্জ রেটের পার্থক্য, রেমিট্যান্স পাঠাতে উচ্চ খরচ, ব্যাংকিং সেক্টরের প্রতি অনাস্থা, অন্যায্য করনীতির কারণে ব্যবসায়ীদের আন্ডার ইনভয়েসিং করার প্রবণতা, ভিসা ক্রয়ের জন্য রিক্রুটিং এজেন্সিদের বিদেশে অর্থের প্রয়োজনীয়তাসহ আরও নানা কারণ কাজ করছে রেমিট্যান্স কমে যাওয়ার পেছনে।

ডিজিটাল প্রক্রিয়ায় কম খরচে রেমিট্যান্স প্রেরণের আন্তর্জাতিক যে ব্যবস্থা রয়েছে, তা বাংলাদেশে প্রয়োগের অসুবিধাগুলো অনুসন্ধান করে এবং সেগুলো দূর করে তা চালু করা যায় কি না, তা বিবেচনা করতে হবে। সে ক্ষেত্রে গ্রাহকের ঝুঁকি প্রশমনের জন্য ভোক্তা প্রতিরক্ষা আইন প্রণয়নের প্রয়োজন পড়বে। অন্তর্বর্তী সরকারকে খুব দ্রুত রেমিট্যান্স আহরণ ও বিনিয়োগসংক্রান্ত বিষয়ে নীতিমালা তৈরির জন্য একটি কমিশন গঠন করতে হবে।

ওপরে উপস্থাপিত চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে হলে চাই পরিকল্পনা, সময়নির্দিষ্ট বাস্তবায়নের ধাপ, অর্থায়ন, নাগরিক সমাজের সঙ্গে অংশীদারত্ব, অভিবাসনের দেশগুলোর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা ও বহুপক্ষীয় ফোরামে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখা।

এ কাজ শুধু দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টার পক্ষে একা করা সম্ভব নয়, চাই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয় এবং অর্থবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত একটি আন্তমন্ত্রণালয় কমিটি।

এই কমিটির অধীনে অভিবাসন বিষয়ে অভিজ্ঞ অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি সংগঠন ও বিশেষজ্ঞরা তৈরি করতে পারেন প্রয়োজনীয় কর্মপরিকল্পনা। আমরা আশা করব, অন্তর্বর্তী সরকার স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি অভিবাসীদের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দ্রুততার সঙ্গে বিবেচনা করবে এবং এ বিষয়ে একটি রূপরেখা দ্রুত জনগণের কাছে উপস্থাপন করবে।

  • তাসনীম সিদ্দিকী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার, রামরু
ট্যাগ :

শেয়ার করুন

শ্রম অভিবাসন থেকে অব্যবস্থাপনা নিরসনে কিছু প্রস্তাব

সময় : ১০:২৭:৫৭ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২০ অগাস্ট ২০২৪

ছাত্র-জনতার সফল গণ–অভ্যুত্থানের পর ৮ আগস্ট বিশ্বজনবিদিত প্রফেসর ড. মুহম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। এই অন্তর্বর্তী সরকার দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ব্যাপক সমর্থন ইতিমধ্যে লাভ করেছে।

এ সরকারের কাছে মানুষের, বিশেষ করে আন্দোলনকারী ছাত্র–জনগোষ্ঠীর প্রত্যাশাও ব্যাপক। শুধু নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচন পরিচালনা করাকে এই সরকারের কাজ বলে মনে করছেন না কেউই। নির্বাচনের পূর্বে পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে প্রয়োজন রাজনৈতিক ব্যবস্থার কাঠামোগত, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও আরও বহু ক্ষেত্রে সংস্কার।

১৯৯৫ সাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা, নীতি পরিবর্তন ও মাঠপর্যায়ে অভিবাসীদের সেবা দানকারী প্রতিষ্ঠান রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট (রামরু) অভিবাসী কর্মীদের অধিকার আদায়ের জন্য বিভিন্ন রকম নীতিপরামর্শ প্রদান করে আসছে। প্রতিষ্ঠানটির সৌভাগ্য হয়েছে সরকারের বিভিন্ন নীতির খসড়া প্রণয়নে নেতৃত্ব দানে। বিগত সরকারগুলো এর কিছু কিছু বাস্তবায়ন করলেও অভিবাসীদের অধিকারের বিষয়টি সব সময়ই অবহেলিত রয়ে গেছে।

রামরুর গবেষণায় দেখা যায়, উনিশ শতাংশ অভিবাসী আংশিক অথবা সম্পূর্ণ অভিবাসন ব্যয় নির্বাহ করেও বিদেশে যেতে পারেননি। আরও ৩১ ভাগ বিদেশে যাওয়ার পর নানা রকম হয়রানির শিকার হয়েছেন। কেউ কেউ কাজ ও বেতন না পেয়ে অল্প সময়ের ভেতর ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন, কেউবা শারীরিক ও মানসিক নিগ্রহ সহ্য করেছেন। নারী শ্রমিকদের একাংশ অন্যান্য প্রতারণার পাশাপাশি যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন, এমনকি লাশ হয়েও ফিরেছেন অনেকে।

অভিবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতির চালিকা শক্তি হলেও এর ব্যবস্থাপনায় এখনো রয়েছে ঘাটতি। কোভিড-১৯–এর পরে প্রত্যাবর্তিত অভিবাসীদের পুনর্বাসনের বিষয়টি বিবেচনার জন্য জোর দাবি উঠেছে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে।

এবারের গণ–অভ্যুত্থানে রেমিট্যান্স পাঠানো বন্ধ করে অভিবাসীরা সরাসরি অংশগ্রহণ করেছেন। তাঁদের এই অবদানকে মূল্যায়ন করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে খুব দ্রুত কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। রামরুর দীর্ঘদিনের কর্ম অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আগামীতে অভিবাসনে সুশাসন আনতে হলে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন, তা নিম্নে উপস্থাপন করা হলো—

দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্পমেয়াদি অভিবাসী বাংলাদেশি নাগরিকেরা দীর্ঘদিন ধরে ভোট প্রদানের সুযোগ চাচ্ছেন। নির্বাচন কমিশন বিভিন্ন সময় এটি নিয়ে আলোচনা করলেও এর বাস্তবায়ন করেনি। অভিবাসী বাংলাদেশি কর্মীদের সাধারণ নির্বাচনে ভোটদানের সুযোগ অনুসন্ধানের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

১. ২০০১ সালে তদানীন্তন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সৃষ্টি করা ‘ন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজি অন স্ট্রিমলাইনিং লেবার রিক্রুটমেন্ট ২০০১’- এর আলোকে নতুন নির্বাচিত সরকার অভিবাসীদের জন্য প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সৃষ্টি করেছিল। ২০০৯ সাল নাগাদ অভিবাসনকে অর্থনীতির ‘থ্রাস্ট সেক্টর’ হিসেবে ঘোষণা করা হলেও এই মন্ত্রণালয়ের বাজেট অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের তুলনায় সর্বনিম্ন পর্যায়ে থেকে গেছে।

দীর্ঘদিন ধরে রাজস্ব বাজেটের ন্যূনতম ১ শতাংশ এই খাতে বরাদ্দ করা অথবা প্রতিবছর যে পরিমাণ রেমিট্যান্স দেশে আসে, তার ৫ শতাংশ সমমানের বরাদ্দ কর্মী ও তাঁর পরিবারের অধিকার রক্ষা ও সেবায় ব্যয় করার দাবি জানিয়ে আসছে নাগরিক সমাজের প্রতিষ্ঠানগুলো। আমরা আশা করব, অন্তর্বর্তী সরকার এই ন্যায্য দাবির প্রতি দৃষ্টিপাত করবে।

২. দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্পমেয়াদি অভিবাসী বাংলাদেশি নাগরিকেরা দীর্ঘদিন ধরে ভোট প্রদানের সুযোগ চাচ্ছেন। নির্বাচন কমিশন বিভিন্ন সময় এটি নিয়ে আলোচনা করলেও এর বাস্তবায়ন করেনি। অভিবাসী বাংলাদেশি কর্মীদের সাধারণ নির্বাচনে ভোটদানের সুযোগ অনুসন্ধানের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

৩. নারী অভিবাসন থেকে আধুনিক দাসত্ব বন্ধ করে নিরাপদ কর্মসংস্থানের সুযোগ খোঁজা, নির্যাতিত ও কর্মচ্যুত নারী অভিবাসীদের আইনি সহায়তা, মনোসামাজিক সেবা, অভিবাসনের দেশে সেফ হোম সৃষ্টি, যৌন নির্যাতনের কারণে জন্ম নেওয়া শিশুর রক্ষণাবেক্ষণসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

৪. ন্যায়সংগত ও নৈতিক নিয়োগ নিশ্চিত করার জন্য অভিবাসন প্রক্রিয়াকরণকে সিন্ডিকেটমুক্ত করা প্রয়োজন। ব্যক্তিগতভাবে সংগৃহীত ভিসা, রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে প্রক্রিয়াকরণের নিয়মটি বন্ধ করে ডেমো অফিসগগুলোকে শক্তিশালী করা দরকার। ভালো মানের কোম্পানি ভিসা সংগ্রহে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে বাধ্য করা, সাব-এজেন্টদের অনানুষ্ঠানিক সেবাগুলোকে আনুষ্ঠানিক কাজের অংশে পরিণত করা আবশ্যক।

৫. প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় একটি বিশেষায়িত মন্ত্রণালয়। আমলাতন্ত্রের সাধারণ বদলির নিয়মের ভেতর মন্ত্রণালয়টি চলে বলে অভিবাসন বিষয়ে যাঁরা দক্ষতা অর্জন করেন, কয়েক বছরের মাথায় তাঁরা অন্য মন্ত্রণালয়ে চলে যান। পরবর্তী কর্মকর্তাকে আবার নতুন করে সব শিখতে হয়। এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালনের জন্য ‘ক্যাডার সার্ভিস’ চালু করা প্রয়োজন।

৬. অভিবাসন ব্যবস্থাপনায় প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেমন বিএমইটি, ডেমো, টিটিসি, বোয়েসেল, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক ইত্যাদির প্রাতিষ্ঠানিক কর্মদক্ষতার মূল্যায়ন করে এগুলোকে শক্তিশালী করার নীতিমালা তৈরি করা।

৭. জাতীয় দক্ষতা নীতিতে আন্তর্জাতিক অভিবাসীদের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হয়নি। প্রতিযোগিতামূলক আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী জনবল সৃষ্টির জন্য দক্ষতা বৃদ্ধিবিষয়ক কর্মপরিকল্পনা ও বাজেট বরাদ্দ করা প্রয়োজন।

৮. কয়েক বছর ধরেই বিভিন্ন কারণে আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায় রেমিট্যান্স হ্রাস পাচ্ছে, নতুবা এর প্রবৃদ্ধির হার কমছে। মুদ্রাস্ফীতি, আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক প্রবাহে এক্সচেঞ্জ রেটের পার্থক্য, রেমিট্যান্স পাঠাতে উচ্চ খরচ, ব্যাংকিং সেক্টরের প্রতি অনাস্থা, অন্যায্য করনীতির কারণে ব্যবসায়ীদের আন্ডার ইনভয়েসিং করার প্রবণতা, ভিসা ক্রয়ের জন্য রিক্রুটিং এজেন্সিদের বিদেশে অর্থের প্রয়োজনীয়তাসহ আরও নানা কারণ কাজ করছে রেমিট্যান্স কমে যাওয়ার পেছনে।

ডিজিটাল প্রক্রিয়ায় কম খরচে রেমিট্যান্স প্রেরণের আন্তর্জাতিক যে ব্যবস্থা রয়েছে, তা বাংলাদেশে প্রয়োগের অসুবিধাগুলো অনুসন্ধান করে এবং সেগুলো দূর করে তা চালু করা যায় কি না, তা বিবেচনা করতে হবে। সে ক্ষেত্রে গ্রাহকের ঝুঁকি প্রশমনের জন্য ভোক্তা প্রতিরক্ষা আইন প্রণয়নের প্রয়োজন পড়বে। অন্তর্বর্তী সরকারকে খুব দ্রুত রেমিট্যান্স আহরণ ও বিনিয়োগসংক্রান্ত বিষয়ে নীতিমালা তৈরির জন্য একটি কমিশন গঠন করতে হবে।

ওপরে উপস্থাপিত চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে হলে চাই পরিকল্পনা, সময়নির্দিষ্ট বাস্তবায়নের ধাপ, অর্থায়ন, নাগরিক সমাজের সঙ্গে অংশীদারত্ব, অভিবাসনের দেশগুলোর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা ও বহুপক্ষীয় ফোরামে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখা।

এ কাজ শুধু দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টার পক্ষে একা করা সম্ভব নয়, চাই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয় এবং অর্থবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত একটি আন্তমন্ত্রণালয় কমিটি।

এই কমিটির অধীনে অভিবাসন বিষয়ে অভিজ্ঞ অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি সংগঠন ও বিশেষজ্ঞরা তৈরি করতে পারেন প্রয়োজনীয় কর্মপরিকল্পনা। আমরা আশা করব, অন্তর্বর্তী সরকার স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি অভিবাসীদের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দ্রুততার সঙ্গে বিবেচনা করবে এবং এ বিষয়ে একটি রূপরেখা দ্রুত জনগণের কাছে উপস্থাপন করবে।

  • তাসনীম সিদ্দিকী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার, রামরু