আজিজ-বেনজীরকে এমন পিএইচডি কীভাবে দিল বিশ্ববিদ্যালয়
- সময় : ০৭:০৮:০৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২০ অগাস্ট ২০২৪
- / ৮ বার দেখেছে
সারা বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রচলিত বিদ্যাতয়নিক ডিগ্রির বাইরে খ্যাতিমান ব্যক্তিদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে কর্মদক্ষতা ও মানবহিতৈষী কাজের অবদানের জন্য ‘সম্মানজনক ডক্টরেট ডিগ্রি’ বা অনারারি ডিগ্রি প্রদান করে আসে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ দেশের অনেক খ্যাতিমান ব্যক্তির এসব ডক্টরেট ডিগ্রি আছে। মূলত এসব ব্যক্তির সামাজিক, সাংস্কৃতিক বা রাষ্ট্রে বৈপ্লবিক অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে এসব ডিগ্রির মূল্যায়ন শত পিএইচডির চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
আমাদের দেশের ‘কিছু মানুষ’ ক্ষমতায় থাকাকালে নিজের অবদানে ঠিক এই ধরনের ‘সম্মান’ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ হওয়ায় ‘একাডেমিকভাবে পিএইচডি’ নেওয়ার হিড়িক পড়েছে। দেশি পিএইচডির বাজার যা–ই হোক না কেন, নামের আগে ‘ড.’ লেখার খায়েস পূরণের নিমিত্তে এই সব ‘ডিগ্রি’ এখন সমাজে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশে এই ট্রেন্ড থাকুক না থাকুক, এটি খুবই ভালো সংবাদ যে আমাদের দেশের আমলা কিংবা সরকারি কর্মকর্তারা নিজেদের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে একাডেমিক জ্ঞান অর্জনের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আর তা করতেই দেশের ‘করের’ টাকায় ‘প্রধানমন্ত্রী ফেলোশিপ’ নামে তো একধরনের ফেলোশিপই কয়েক বছর আগে চালু করা হয়েছে, যা ভিনদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ‘সরকারি কর্মকর্তারা’ টিউশন ফি, থাকা খাওয়ার সব খরচই মিটিয়ে যাচ্ছে।
যদিও বাইরের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করতে এলে ইংরেজি ভাষার দক্ষতার সনদ ছাড়াও আরও নানা শর্ত পূরণের প্রয়োজন পড়ে, সেই হিসেবে যেসব ‘কর্তা’ এসবের ধার ধারেন না, তাঁরা চাকরিরত থাকা অবস্থায় দেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন পিএইচডি অর্জন করে ফেলছেন।
ভর্তির নিয়মনীতি তোয়াক্কা না করে ‘জ্ঞান অন্বেষণের’ স্বাদ যে জেঁকে বসেছে, সেই জ্ঞানে ‘বাংলাদেশ’ কতটা উপকৃত হচ্ছে, তা সাম্প্রতিক সময়ের পত্রপত্রিকার কিছু ঘটনার দিকে নজর দিলে বোঝা যাবে।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ গোটা দেশে জমি কিনে হইচই ফেলে দিয়েছেন। তাঁর এই ‘জমিদারি’ কায়েমের বিষয়টি একের পর এক পত্রিকায় প্রকাশের পর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তাঁর পরিবারের সেসব জমি, ব্যবসা ও শেয়ার ব্যবসার সম্পদ আদালতের আদেশে জব্দ করা হয়েছে। এই ডামাডোলে বের হয়ে আসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ থেকে নেওয়া তাঁর ডক্টর অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (ডিবিএ) ডিগ্রির ভর্তি জালিয়াতির খবর (প্রথম আলো, জুন ১৩)।
থিসিস জমার পূর্ব স্বীকৃত মানের জার্নালে একক অর্থের হিসাবে অন্তত একটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হবে। বেনজীর আহমেদের গবেষণাটি ‘আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে বাংলাদেশের জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীর অবদান’ আমি অন্তত কোনো জার্নালে খুঁজে পাইনি; বরং বেনজীর আহমেদের বাংলাদেশ পুলিশ ইন ইউএন পিসকিপিং ফোর্স শীর্ষক একটি বইয়ের গত বছর একুশের বইমেলায় মোড়ক উন্মোচনের খবর পেলাম (বাসস, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩)।
জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনীর অবদানের ওপর গবেষণার ঠিক কী ধরনের নতুনত্ব বা মৌলিকত্ব আছে, তা আমার বোধগম্য না হলেও এই ধরনের ‘যৌগিক’ তত্ত্বে পিএইচডি বা ডিবিএ ডিগ্রি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিতে পারে, তা ভাবতেই তো হতবাক হয়ে যাই। অথচ পিএইচডির মূলনীতিই কিন্তু নতুন জ্ঞান বা গবেষণায় মৌলিকত্ব থাকা বাঞ্ছনীয়। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনের প্রাপ্ত তথ্য গবেষণার যদি উপাত্ত হয়, তাহলে নতুনত্ব নিয়ে প্রশ্ন করা অমূলক বটে।
খবরটি বলছে, ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের অধীন ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের জন্য তৎকালীন র্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদকে নিয়ম শিথিল করে বিশেষ বিবেচনায় ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের অধীন ডিবিএ প্রোগ্রামে ভর্তির অনুমতি প্রদান করা হয়েছে।
‘নিয়ম শিথিলের’ যুক্তি হিসেবে বেনজীরের তত্ত্বাবধায়ক অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম যিনি বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) চেয়ারম্যানও সুপারিশপত্রে লিখেছেন, তিনি (বেনজীর) ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার ও র্যাবের মহাপরিচালক। সমাজের এ রকম একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিকে ডিবিএ প্রোগ্রামে বিশেষ বিবেচনায় হলেও ভর্তির অনুমতি দিলে দেশের কল্যাণে কাজে আসবে।
এমন সুপারিশের ব্যক্তি দেশের ঠিক কতটা কল্যাণে এল, তা সাম্প্রতিক সময়ে তাঁর দুর্নীতি-অনিয়মের সম্পদলোভীর চিত্রটা দেশবাসী জানার সুযোগ পেয়েছে। ‘পদ–পদবির’ পদতলে দলিত হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রোগ্রামের ভর্তিযোগ্যতা নিয়ে পত্রপত্রিকায় খবর বের হলেও কিছু মৌলিক প্রশ্নের দায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এড়াতে পারে না। আর এই দায়ে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ নিজের আয়নায় নিজেকে চিনতে পারবে বলে মনে হয় না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতি শিক্ষাবর্ষে পিএইচডি ভর্তির যে কেন্দ্রীয় বিজ্ঞপ্তি দেয়, সেখানে স্পষ্ট ভর্তির যোগ্যতায় উল্লেখ আছে, তিন–চার বছর মেয়াদি স্নাতক ও এক বছর মেয়াদি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি থাকতে হবে। চার বছর মেয়াদি পিএইচডির নিয়মিত কোর্সে চাকরিরতদের জন্য কমপক্ষে এক বছরের শিক্ষাছুটি নিয়ে পিএইচডি প্রোগ্রামে যোগদান করতে হবে। আর খণ্ডকালীন কোর্সে ভর্তি হতে গেলে, ছুটি থাকা বাধ্যতামূলক নয়, তবে ‘নিয়োগকর্তার’ অনুমতি নিতে হবে।
আমরা জানি না, বেনজীর আহমেদ নিয়মিত না খণ্ডকালীন কোর্সে ভর্তি হয়েছিলেন। পুলিশের সাবেক কর্তা বেনজীর আহমেদ যখন ভর্তি হয়েছিলেন, তখন তিনি র্যাবের মহাপরিচালক ছিলেন।
এ সময় যদি তিনি নিয়মিত পিএইচডি কোর্সে ভর্তি হোন, তাহলে তাঁকেও এই শর্তের মধ্যে পড়তে হয়েছে; কিন্তু বেনজীর আহমেদ আদৌও কি র্যাবের মহাপরিচালক পদ থেকে সরে গিয়ে এই ‘শিক্ষা ছুটি’ নিয়েছিলেন? আর যদি খণ্ডকালীন কোর্সে ভর্তি হন, তিনি কি সরকারের অনুমতি গ্রহণ করেছিলেন?
কেন্দ্রীয় এই পিএইচডি বিজ্ঞপ্তিতে স্পষ্টে উল্লেখ আছে, ‘পিএইচডি/ডিবিএ গবেষকদের ন্যূনতম দুটি উন্মুক্ত সেমিনারের আয়োজন করতে হবে যেখানে গবেষকদের প্রবন্ধ উপস্থাপন করতে হবে শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের সামনে।’
এখন প্রশ্ন হলো, বেনজীর আহমেদ ডক্টরেট ডিগ্রি নেওয়ার আগে এসব থিসিস সেমিনারে ঠিক কারা উপস্থিত ছিলেন? ঠিক কতজন শিক্ষক বা শিক্ষার্থী বেনজীর আহমেদের সেমিনার থাকার সুযোগ পেয়েছিলেন?
জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনীর অবদানের ওপর গবেষণার ঠিক কী ধরনের নতুনত্ব বা মৌলিকত্ব আছে, তা আমার বোধগম্য না হলেও এই ধরনের ‘যৌগিক’ তত্ত্বে পিএইচডি বা ডিবিএ ডিগ্রি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিতে পারে, তা ভাবতেই তো হতবাক হয়ে যাই। অথচ পিএইচডির মূলনীতিই কিন্তু নতুন জ্ঞান বা গবেষণায় মৌলিকত্ব থাকা বাঞ্ছনীয়। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনের প্রাপ্ত তথ্য গবেষণার যদি উপাত্ত হয়, তাহলে নতুনত্ব নিয়ে প্রশ্ন করা অমূলক বটে।