চাঁপাইনবাবগঞ্জ: খরা পরে, আগে শূকর ঠেকান
- সময় : ০৬:৪১:০২ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২০ অগাস্ট ২০২৪
- / ৯ বার দেখেছে
পানির অভাবে অনেকেই এবার ধান চাষে আগ্রহী হননি। গাছের জন্য জানকবুল বৃক্ষপ্রেমী কার্তিক পরামানিক হাঁটতে হাঁটতে দেখালেন পতিত জমিগুলো। হয়রান আলী, মুকুন্দ মাল জানালেন, প্রথমে তাঁরা ভেবেছিলেন, নিচের পানি দিয়ে ধান করবেন। কিন্তু পাতালেও পানি নেই। ১৫০–২০০ ফুট না গেলে পানি মিলছিল না। মুকুন্দ বললেন, ‘ও আমাদের কম্ম নয়। পড়তা পড়ে না। তাই মাঠের পর মাঠ পড়ে থাকে অধান হয়ে।’
‘অপার’ কথাটা লালনের কল্যাণে শোনা হলেও ‘অধান’ শুনলাম এই প্রথম। চাষির কলিজা–ফাড়া এই শব্দে ছাতি শুকিয়ে যাবে, তেষ্টা পাবে। তারপরও মাঠের চাষিরা নদীর পানি, খরা আর ফারাক্কা নিয়ে একটু কম আগ্রহী বলে মনে হলো। মাঠে এখন তাঁদের অন্য সমস্যা। খরায় ধান মার খেলেও ‘চীনা’ হয়েছে। খরাসহনীয় চীনা ধানের এখন কদর বেড়েছে। বিস্কুট কোম্পানিরা বাড়ি থেকেই নিয়ে যাচ্ছে। প্রতি মণ চীনা বিক্রি হয় কম করে ৫ হাজার টাকা দরে। বিঘাপ্রতি ফলন ফেলেঝেলে ৪–৫ মণ। চীনা লাগানো থেকে ঘরে তোলা পর্যন্ত বিঘাপ্রতি খরচ পড়ে হাজার পাঁচেক টাকা।
চীনা কী
একসময় চরের জেগে ওঠা নতুন–পুরোনো জমিতে এর ব্যাপক চাষাবাদ হতো। বীজ ছিটিয়ে অল্প খরচের এই চাষে উৎপাদিত চীনা সাধারণ চালের বিকল্প ছিল। চরের গরিব মানুষের ভাতের উৎস ছিল চীনা। ছোট আকারের ধান হওয়ায় বাজারে আতপ চালের মতো এখন এর চাহিদা। সচ্ছল মানুষের শখের পায়েস রান্নায় চীনা চালের কদর বেড়েছে। তা ছাড়া এখন ‘শিশুখাদ্যের’ অন্যতম উপাদান এটি। ফলে বাজারে এখন এর ব্যাপক চাহিদা। কোনো কোনো জায়গায় এখন এই ফসল অগ্রিম বিক্রি হচ্ছে। ফলে বাজারজাত করার কোনো ঝুঁকি নেই চাষিদের।
গরিবের ফসল এই চীনা ধান ও কাউন রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার মনাকষা ইউনিয়নের সীমান্ত লাগোয়া গ্রামের (ঠুঁঠাপাড়া, তারাপুর, মড়লপাড়া ইত্যাদি) ফসলি জমিতে বুনো শূকরের হানা এখন নিত্যদিনের ঘটনা। ফসল বাঁচাতে রাত জেগে পাহারা দিয়েও খুব একটা লাভ হচ্ছে না। রাত জেগে পাহারা দিতে গিয়ে বুনো শূকরের হামলার শিকার হয়েছেন অনেকে। তাঁদের পিঠে, হাতে, পায়ে কামড় দেয়। আহতদের হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়েছে। নিরুপায় মানুষ গত বছরে ‘জ্যোষ্টি’ মাসে গোটা সাতেক বুনো শূকর মেরে ফেলেছিল। এত কিছুর পরও হানা বন্ধ হয়নি। গ্রামের মানুষ জানালেন, প্রতিদিনই ১০০-১৫০টি বুনো শূকর দল বেঁধে জমিতে নেমে আসে। একেকটা পাল কম করে হলেও এক রাতে নষ্ট করতে পারে প্রায় ৪০০ বিঘা জমির ফসল।
বিজিবি ৫৩ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. মনিরুজ্জামান চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রথম আলোর প্রতিবেদককে বলেছেন, ‘সীমান্ত এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে আমি নিজে দেখেছি ভারতীয় বন্য শূকরের দল। বিষয়টি নিয়ে আমরা বিএসএফের সঙ্গে আলোচনা করব।’
কোথা থেকে আসে এরা
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলা থেকে বুনো শূকর সীমান্ত পেরিয়ে ফসলের মাঠে আসে। বাংলাদেশ-পশ্চিমবঙ্গ সীমান্ত এলাকার বেশির ভাগ জায়গা কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা আছে। তবে মুর্শিদাবাদের যে জংলা এলাকায় বুনো শূকর থাকে, সেই এলাকাটি জঙ্গল ও নদীর ধারে হওয়ায় সেখানে কোনো তারের বেড়া নেই। ফলে অবাধে বুনো শূকরের দল চলাফেরা করতে পারে। রাতের অন্ধকারে এপারে এসে সারা রাত থেকে আবারও ভোরের আলো ফোটার আগেই সীমান্ত পেরিয়ে ফিরে যায় তাদের ডেরায়।
একেকটা বুনো শূকরের ওজন ৮০ থেকে ১০০ কেজি। যে ফসলের ওপর দিয়ে ছোটাছুটি করে, সেখানকার সব শেষ করে দেয়। গম ও ভুট্টা তাদের পছন্দের খাবার। ধান বা চীনা খুব একটা খায় না। তবে বিশালদেহী শূকর ছোটাছুটি করার ফলে ধানের ফলন ঝরে যায়। যে জমির ওপর দিয়ে শূকরের দল যায়, তা ধ্বংস হয়ে যায়। ধান কাটার পর শুকানোর জন্য আঁটি বেঁধে মাঠে রাখার চল থাকলেও সেটা এখন আর হচ্ছে না। কাটা ধানের ওপর দিয়ে শূকর গেলে ক্ষতি আরও বেশি হয়।
সীমান্ত এলাকা বলে গভীর রাতে পাহারা দেওয়াটাও নিরাপদ নয়। কারণ, কয়েক গজ দূরত্বে জিরো লাইন। ওপারে বিএসএফ, এপারে বিজিবি। রাতের অন্ধকারে পাহারা দিতে এলেই নানা রকম হয়রানি ও ভোগান্তিতে পড়তে হয়।
শুধু ফসল নয়, অন্য প্রাণীরাও বন্য শূকরের দাপটে অস্তিত্ব–সংকটে আছে। বাঘরোল (ফিশিংক্যাট), বনবিড়াল (জঙ্গলক্যাট), ভাম, শিয়াল, শজারুর মতো স্থানীয় বন্য প্রাণীরাও প্রাণ হারাচ্ছে এদের দলবদ্ধ আক্রমণে।
জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট অব অ্যানিমেল বিহেভিয়ারের বিজ্ঞানীরা মনে করেন, বন্য শূকরের মাধ্যমে আফ্রিকান সোয়াইনের ভাইরাস সহজেই ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাঁদের গবেষণায় দেখা গেছে, অত্যন্ত সংক্রামক ভাইরাসটি বন্য শূকর এবং গৃহপালিত শূকরের মধ্যে সহজেই ছড়িয়ে পড়ে। যদিও ভাইরাসটি মানুষের মধ্যে সংক্রমণের নজির এখনো পাওয়া যায়নি। তবে শূকর থেকে অন্য প্রাণী বিশেষ করে গৃহপালিত শূকরের মধ্যে এটা সহজেই সংক্রমিত হয়।
আমাদের দেশে গৃহপালিত শূকরের সংখ্যা কম নয়। আফ্রিকান সোয়াইন ফিভার বিশ্বব্যাপী শূকরশিল্পের জন্য একটি বড় হুমকি এবং এর উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব রয়েছে। গত বছরের নভেম্বরে রাঙামাটিতে শূকর উন্নয়ন খামারে মাত্র ৯ দিনে শতাধিক শূকর মারা যায় সোয়াইন ফিভারে। রাঙামাটির জেলা প্রাণিসম্পদ অফিস ভয়াবহ এই ভাইরাসের অস্তিত্ব নিশ্চিত করে।
চট্টগ্রামে ও পার্বত্য এলাকায় বন্য শূকরের আক্রমণ নতুন কিছু নয়। মানুষ হতাহত না হলে এসব খবর সংবাদমাধ্যম বা প্রাণী অধিদপ্তরের নজরে আসে না। গত বছরের ২ অক্টোবর হাটহাজারীর ধলই ইউনিয়নের পশ্চিম ধলই গ্রামে বন্য শূকরের আক্রমণে অন্তত সাতজন আহত হয়েছিল।
উপায় কী
উপদ্রুত এলাকার একজন জানালেন, ‘ফসল নষ্ট হতে থাকায় আমরা গ্রামের হাজারখানেক লোক এক রাতে মাঠে এসেছিলাম। সাঁওতাল সম্প্রদায়ের লোকজনকেও ডেকেছিলাম, যারা বুনো শূকরের মাংস খায়। সেদিন রাতে বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে দুটি বুনো শূকর মারা হয়। এরপরও তাদের আক্রমণের মাত্রা একটুও কমেনি।’
তা ছাড়া বৈদ্যুতিক তারের ফাঁদে অন্য প্রাণীর এমনকি মানুষেরও প্রাণহানি ঘটতে পারে, ঘটেও। তাই হত্যা কোনো সমাধানের পথ নয়। পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞ গবেষক তিয়াসা আঢ্যও বলেছেন, দু-দশটা শূকর মেরে সমস্যার সমাধান হবে না। বরং অন্য বন্য প্রাণীদের বিপদ বাড়বে। শূকর খুব বুদ্ধিমান প্রাণী। বিপদের বিন্দুমাত্র আঁচ পেলেই পুরো দল অপেক্ষাকৃত নিরাপদ এলাকায় পাড়ি দেয়।
পশ্চিমবঙ্গের বন বিভাগের ট্রাঙ্কুইলাইজার দল আছে, তারা খবর পেলে ঘুমপাড়ানি ওষুধ নিয়ে ছুটে যায় উপদ্রুত এলাকায়। দূর থেকে একধরনের বন্দুকের সাহায্যে ঘুমপাড়ানি ওষুধ ঢুকিয়ে দেয় শূকরের শরীরে। তারপর সেটিকে আবার জঙ্গলে ছেড়ে দেয়। সীমান্ত এলাকায় এটা করতে গেলে দুই দেশের মধ্যে একটা সমঝোতা দরকার। সমাধানের সূত্র খোঁজার আগে আমাদের সমস্যাটি কবুল করতে হবে, আমলে নিতে হবে তার বিভিন্ন প্রতিক্রিয়াকে। আমাদের কৃষি বিভাগ মনে করে, এটা বন বিভাগের কাজ। বন বিভাগ সারা রাত জেগে খেতে বসে চিল্লাচিল্লি (তাদের ভাষায় সাউন্ড) করার পরামর্শ দিয়েই খালাস।