অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে সংবাদমাধ্যমের সুরক্ষা ও স্বাধীনতার আশ্বাস দেয়া হলেও একটি মহলের হুমকি, হামলা এখনো চলমান। এর পেছনে সরকারের ‘নিষ্ক্রিয়তার’ ভূমিকাও দেখছেন বিশ্লেষকরা।
বাংলাদেশের শীর্ষ দুইটি দৈনিক প্রথম আলো এবং দ্য ডেইলি স্টার-এর প্রধান কার্যালয়ের সামনে কিছু লোক বিক্ষোভ করেছে। প্রথম আলোর সামনে তারা গরু জবাই করে জিয়াফত (মৃত ব্যক্তির আত্মার শান্তির জন্য ভোজ) কর্মসূচি পালনেরও চেষ্টা করেছে। রোববার পুলিশ অবশ্য সেই কর্মসূচি ভন্ডুল করে দিয়েছে।
তার আগে শনিবার তারা দ্য ডেইলি স্টারের সামনেও বিক্ষোভ করে। ওই ব্যক্তিদের দাবি, বাংলা দৈনিক প্রথম আলো এবং ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার ‘ভারতের দালাল’- এই সব আয়োজন হচ্ছে তৌহিদী জনতাসহ নানা ব্যানারে।
প্রথম আলোর প্রধান কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভেই বিষয়টি সীমাবদ্ধ থাকেনি। রবিবার কতিপয় ব্যক্তি রাজশাহী ও বগুড়ায় প্রথম আলো কার্যালয়ে হামলা চালায়। এছাড়া বেশ কয়েকটি জেলা শহর ও বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল করা হয়। এসবের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও চালানো হয় প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারবিরোদী প্রচারণা।
আরো পড়ুনঃ তিন মাস না যেতেই আসল চেহারা বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে: মির্জা ফখরুল
সাম্প্রওতিক সময়ে সংবাদ মাধ্যমের কার্যালয়ে হামলার ঘটনা আরো বেশ কিছু ঘটেছে।৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের দিন এবং তারপরে সময় টেলিভিশন , ডিবিসি, একাত্তর টিভি, এটিএন বাংলা, এটিএন নিউজও আরো কয়েকটি বেসরকারি স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলের কার্যালয়ে হামলা ও ভাঙচুর চালানো হয়।
এছাড়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তথ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে ১৬৭ জন সাংবাদিক ও সম্পাদকের প্রেস অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিল করার বিষয়টিও সমালোচিত হয়েছে। এসবের বাইরে আলোচনা-সমালোচনায় এসেছে বেশ কয়েকজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যা ও গণহত্যার মামলা করার বিষয়টি। অনেক প্রতিষ্ঠানের সাংবাদিকদের চাকরি ছাড়তে বাধ্য করার অভিযোগও রয়েছে।
প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টার কার্যালয়ের সামনের সাম্প্রতিক গরু জবাই করে জিয়াফত কর্মসূচি পালনের চেষ্টার পর বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা চরম আক্রমণের মুখে বলে মন্তব্য করেছে সংবাদপত্রের মালিকদের সংগঠন নিউজপেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব)।
নোয়াবের সভাপতি এ কে আজাদ স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “নোয়াব উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছে, দেশের সংবাদমাধ্যমগুলোর স্বাধীনতার ওপর নানাভাবে আক্রমণ অব্যাহত রয়েছে।”
গরু জবাই করে জিয়াফত পালন চেষ্টার মতো ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে গণমাধ্যমসহ সব ধরনের প্রতিষ্ঠানে তথাকথিত ‘মব জাস্টিস’-এর প্রয়াস কঠোর হাতে দমন করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বানও জানানো হয়। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার পরিপন্থি কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার অনুরোধও জানায় নোয়াব।
এর আগে সম্পাদক পরিষদসহ সাংবাদিক এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক একাধিক সংগঠন হামলাসহ গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় অন্তরায় এমন কাজ যাতে না হয় তার ব্যবস্থা নেয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানায়। জবাবে সরকারও বারবার গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি দেয়।
মঙ্গলবার ঢাকা রিপোটার্স ইউনিটির নেতারা সচিবালয়ে তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তিনি সাংবাদিক নেতাদের বলেন, “এখানে একটি ল অ্যান্ড অর্ডার সিচুয়েশন (আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি) তৈরি হয়েছে। সে জায়গা থেকে সরকার ভূমিকা পালন করবে। পত্রিকা অফিসে ভাঙচুর হলে, সেটা অবশ্যই আইনগতভাবে দেখা হবে। কিন্তু এটা কেবল আইনি বিষয় নয়, বিগত সময়ে নানা গণমাধ্যমের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমের ওপর মানুষের ক্ষোভ তৈরি হয়েছে।”
তার কথা, “গণমাধ্যমে ফ্যাসিবাদের এক শ্রেণীর দোসর সৃষ্টি হয়েছে। ফলে গণমাধ্যমের প্রতি জনগণের আস্থা এবং বিশ্বাস নষ্ট হয়ে গেছে। তা ফিরিয়ে আনতে সাংবাদিকদেরই ভূমিকা পালন করতে হবে।”
ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) এর সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন আহমেদ। তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, “ওনার (তথ্য উপদেষ্টা) মতে এখন যা হচ্ছে, গণমাধ্যমে অফিসের সামনে যা এখন হচ্ছে, এগুলো গত ১৫ বছর যে রকম সাংবাদিকতা করা হয়েছে, তাতে মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়েছে। যেসব গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের ওপর মানুষের ক্ষোভ আছে, ওইসব প্রতিষ্ঠানের সামনে তারা জড়ো হচ্ছে। তারা এদেশের নাগরিক। তাদের সভা-সমাবেশের অধিকার আছে। আবার একই সঙ্গে গণমাধ্যমের নিরাপত্তা দেওয়াও সরকারের দায়িত্ব। কোথাও যদি কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা হয়, তখন তারা সেটা প্রতিরোধ করবে, নিয়ন্ত্রণ করবে।”
তিনি জানান, “জবাবে ডিআরইউর নেতারা বলেছেন কোনো ব্যক্তি (সাংবাদিক) যদি কোনো অপরাধ করেন, তাহলে ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া যায়। কেউ যদি স্বৈরাচারের দোসর হিসাবে ভূমিকা নেয়, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, মানুষের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় ওই ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা যায়। কিন্তু ঢালাওভাবে ব্যবস্থা নেয়া, সংবাদমাধ্যমের সামনে অবস্থান নিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান। এটা আমরা স্পষ্ট করে বলেছি।”
আগেও অন্তর্বর্তী সরকারের দিক থেকে গণমাধ্যমের সুরক্ষা ও স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে সেটা হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে ডিআরইউ সাধারণ সম্পাদক বলেন,” যেভাবে গণমাধ্যমের সুরক্ষা দেয়া দরকার, সরকার বক্তব্য দিলেও সেভাবে সুরক্ষা দিতে পারছে না। কিছু জায়গায় উন্নতি হয়েছে যে, বিগত সরকারের সময় বিভিন্ন এজেন্সি যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করতো, ফোন করে নিউজ নামাতো, ওঠাতো। সরকারের দিক থেকে সেটা এখন করা হচ্ছে না। কিন্তু বাইরের যে চাপ সেটা থেকে গণমাধ্যমকে সুরক্ষা দিতে পারছে না। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কারুর কারুর দায়িত্বহীন কথা বিশৃঙ্খলা তৈরি করছে।”
সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতারাও তথ্য উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করেছেন। বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব কাদের গনি চৌধুরী বলেন, “গণমাধ্যমের ওপর কেন হামলা হবে? এটা তো নিন্দনীয় কাজ। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাই। কোনো সাংবাদিক বা গণমাধ্যমের যদি কোনো অপরাধ থাকে, সেটার জন্য আইন আছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী আছে তারা দেখবে। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর তো আইন হাতে তুলে নেয়ার সুযোগ নাই। এটা বেআইনী কাজ। ”
“আজকেও আমরা সচিবালয়ে এটা নিয়ে কথা বলেছি। সরকার বলছে তারা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার পক্ষে। সুরক্ষার পক্ষে। তাহলে এগুলো কারা করছে তাদের চিহ্নিত করতে হবে আগে। এটা যারা করছে তারা ফ্যাসিবাদের দোসর কিনা তা-ও দেখতে হবে। আর আমাদেরও দায়িত্ব আছে। স্বাধীনতার নামে হলুদ সাংবাদিকতা করা যাবে না,” বলেন তিনি।
তবে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সুরক্ষার ব্যাপারে অন্তর্বর্তী সরকারের ভুমিকা স্পষ্ট নয় বলে মনে করেন মানবাধিকার কর্মী ও গুম কমিশনের সদস্য নূর খান। তিনি বলেন, “সরকারের যারা নীতিনির্ধারক, তারা আসলে সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা রাখেন কিনা আমার সন্দেহ আছে। তারা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সংহত করার কথা বলার পাশাপাশি তার সঙ্গে আবার ফ্যাসিবাদকে কানেক্ট করছেন, সেই জায়গায় বিভ্রান্তি ছড়িয়ে যেতে পারে। এখন যে ঘটনা ঘটছে- প্রথম আলোর জিয়াফত খাওয়ানো হচ্ছে, হুমকি ধামকি- এটা শুধু আইনবিরোধী না, মানবতার সব কিছুকে লঙ্ঘন করছে।”
” কোনো কোনো মহল থেকে এখন যে ভাষায় কথা বলা হচ্ছে, গণতন্ত্রের নামে, সেটা যদি বহাল থাকে তাহলে গণতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হবে,” বলেন তিনি।
‘‘এইসব হামলা ও হুমকির ঘটনায় এখনো আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। কাউকে আটক বা গ্রেপ্তারও করেনি।”
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, “যারা এগুলো করছে, তারা অপরিচিত কেউ নয়। তাদের চেহারা দেখা যায়। তাদের ভিডিও ফুটেজও আছে। তাদের অতীত, বর্তমান দেশবাসী জানে। তারপরও সরকার বা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।”
“সরকারের মধ্য থেকেই কেউ কেউ বা সরকারের সমর্থক যেভাবে উসকানিমূলক কথা বলছেন তাতে পরিস্থিতি আরো খারাপ হচ্ছে। তাদের যে ব্যাকগ্রাউন্ড আমরা বিভিন্নভাবে দেখছি, আমরা যতই গণতন্ত্রের কথা বলি, প্রকৃতপক্ষে তারা গণতন্ত্রহীন শক্তি। তারা একটি বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষাকারী বলেই আমার মনে হয়।”