০৫:৩৭ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল-ধর্মনিরপেক্ষতা, পঞ্চদশ সংশোধনী ঘিরে যা ঘটেছিল

রিপোর্টার
  • সময় : ১২:৪৯:৪৩ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৪
  • / ১৩ বার দেখেছে

#image_title

সংবিধানের যে সংশোধনীর মাধ্যমে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করাসহ বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছিল, বাংলাদেশের আদালতে বর্তমানে সেই পঞ্চদশ সংশোধনীর বিরুদ্ধে রিটের শুনানি চলছে। ১৩ বছর পর আবার নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরবে কি-না, তা নির্ধারণ হতে পারে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে।

দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের পর ২০১১ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে জাতীয় সংসদে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলসহ সংবিধানে বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছিল।

আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামীসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর দাবিতে ১৯৯৬ সালে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে বিধান আনা হয়েছিল, আওয়ামী লীগের প্রস্তাবেই ২০১১ সালের ৩০ জুন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সেটি বাতিল বাদ দেওয়া হয়।

ওইদিনই এর বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে তৎকালীন জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া বলেছিলেন, জনমতকে উপেক্ষা করে একতরফাভাবে সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে দেশকে অনিবার্য সংঘাতের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বয়কট করেছিল বিএনপিসহ বাংলাদেশের অনেক রাজনৈতিক দল।ওই নির্বাচন বাতিলের দাবিতে হরতাল, অবরোধসহ নানা রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনাও ঘটেছিল বাংলাদেশে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার যেভাবে সংবিধানে

বাংলাদেশে প্রথম কোন তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কার্যক্রম দেখা যায় ১৯৯০ সালে সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের পতনের পর। তখন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদ একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্ব দিলেও সংবিধানে এরকম কোন ব্যবস্থা ছিল না।

১৯৯৪ সালে বিএনপি ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় মাগুরার একটি আসনের উপনির্বাচনে ভোট কারচুপির অভিযোগে দেশে নানা সমালোচনা হয়। তখন নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা চালুর দাবিতে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছিল তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামীসহ অনেক রাজনৈতিক দল।

বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর বয়কট ও প্রতিবাদ উপেক্ষা করে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপি সরকার নির্বাচন আয়োজন করে সরকার গঠন করলেও আন্দোলনের মুখে ক্ষমতায় টিকতে পারেনি।

বিরোধীদের দাবি মেনে সেই ষষ্ঠ সংসদে একদিনের এক অধিবেশনে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধন আনা হয়। তাতে সংবিধানের ২(ক) পরিচ্ছদে যুক্ত হয় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। পরে ওই বছরই জুনে দেশে প্রথমবারের মতো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয় সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তারপর ২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় নির্বাচনও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়।

কিন্তু ২০০৬ সালে বিচারপতি কে এম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান বানানো নিয়ে বাংলাদেশে এক ধরনের সহিংস রাজনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি হয়। যার প্রেক্ষিতে সংকটকালীন অবস্থায় ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশে জরুরি অবস্থা জারি হয়। ক্ষমতায় বসে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবয়াক সরকার। যেটি বাংলাদেশে ‘ওয়ান ইলেভেন’ সরকার নামেও পরিচিত ছিল।

ওই সরকার প্রায় দুই বছর পর ২০০৮ সালের ২৯শে ডিসেম্বর নির্বাচন আয়োজন করে। ওই নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ।

তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল

ত্রয়োদশ সংশোধনীর পাসের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দুটি মামলা হলেও হাইকোর্ট সেগুলো খারিজ করে দেন। কিন্তু হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়েছিল। এরপর ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণের পর তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকসহ সাত বিচারপতির আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ আপিলের শুনানি করে ২০১১ সালের ১০ই মে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী অসাংবিধানিক ঘোষণা করে সংক্ষিপ্ত, বিভক্ত আদেশ দেন সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতিরা।

আদালতের এই রায়কে সেদিন স্বাগত জানায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। আর সংসদের তৎকালীন বিরোধী দল বিএনপি তাদের প্রতিক্রিয়ায় জানায়, আদালতের ওই রায়ের ফলে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সাংবিধানিক সংকট তৈরি হতে পারে। তখন আদালত যে রায় দিয়েছিল সেখানে বলা হয়, পরবর্তী দুটি নির্বাচন পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে। সেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে বিচারপতিদের রাখার বিষয়টি সংসদের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়। এর মাস দেড়েকের মাথায় একই বছরের ৩০শে জুন জাতীয় সংসদে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আনা হয়। এর মধ্য দিয়ে স্থায়ীভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হয়ে যায়।

তৎকালীন বিরোধী দল বিএনপির অনুপস্থিতিতে এই সংশোধনী পাশ হয় সংসদে। এই সংশোধনীতে নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করার কথা বলা হয়। সেই সময় সংসদ ভেঙে না গেলেও কোন অধিবেশন বসবে না বলেও সংশোধনী আনা হয়। এ ছাড়া সংশোধনী অনুযায়ী রাজনৈতিক সরকার শুধু রাষ্ট্রের রুটিন কাজ করবে বলেও বিধান রাখা হয়।

পঞ্চদশ সংশোধনী নিয়ে বিতর্ক

সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর পর এ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্ক জোরালো হয়ে ওঠে। আওয়ামী লীগ ও সমমনা দলগুলো একে স্বাগত জানালেও বিরোধী দলগুলো তীব্র আপত্তি জানায়।
পরদিন দৈনিক খবরের কাগজগুলোতে পঞ্চদশ সংশোধনী বিষয়ে বিএনপির প্রতিক্রিয়া, আওয়ামী লীগের অবস্থানসহ নানা খবর প্রকাশিত হয়।

সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধী দলের উদ্দেশ্যে সংসদে বলেছিলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিয়ে কোনো ফর্মুলা থাকলে বলতে পারেন। অহেতুক জনগণকে কষ্ট দেবেন না। অযথা গণ্ডগোল পাকাবেন না।

সংসদে বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাশের পর তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায় বিএনপি।
প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছিলেন, নিরপেক্ষ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের সব সম্ভাবনা তিরোহিত হলো। এই অপচেষ্টায় দেশে সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠল। গণতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ পন্থায় ক্ষমতা হস্তান্তরের সব পথ রুদ্ধ হয়ে গেল।

ওই সংক্ষিপ্ত আদেশের ১৬ মাস পরে ২০১২ সালের ১৬ই সেপ্টেম্বর যখন পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয় তখন এ বি এম খায়রুল হক প্রধান বিচারপতি পদ থেকে অবসর নেন। তিনি যে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন তাতে পরবর্তী দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা থাকার বিষয়টি ছিল না। এমনকি, সরকারের মেয়াদ শেষ হলেও সংসদ বহাল থাকার কথাও যুক্ত হয় পূর্ণাঙ্গ রায়ে। সংক্ষিপ্ত রায়ের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ রায়ের এই বিশাল অসংগতি নিয়ে তখনই জোরালো বিতর্ক উঠেছিল।
পূর্ণাঙ্গ রায়ে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের সঙ্গে একমত হয়েছেন বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন, বিচারপতি এস কে সিনহা এবং বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন।

আরো পড়ুনঃক্রীড়াঙ্গনে দুর্নীতি হলে খতিয়ে দেখবে মন্ত্রণালয়
রায়ের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে মত দেন বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা। তার সঙ্গে একমত পোষণ করেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা। তবে বিচারপতি মো. ইমান আলী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে বা বিপক্ষে মত না দিয়ে বিষয়টি জাতীয় সংসদের ওপর ছেড়ে দেন।

পঞ্চদশ সংশোধনী ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ

২০১১ সালের ৩০শে জুন জাতীয় সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী আনার দিন সংসদে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের ৩৯ জন ও এলডিপির একজন সংসদ সদস্য সেদিন সংসদে যাননি। তখন সংসদে একমাত্র স্বতন্ত্র সদস্য ফজলুল আজিম বিপক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। আর পক্ষে ভোট পড়েছিল ২৯১টি।

এই পঞ্চদশ সংশোধনী বিলটি তৎকালীন আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ সংসদে এনেছিলেন ২০১১ সালের জুন মাসে।
পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে শুধু তত্ত্বাধায়ক সরকার বাতিলই হয় নি, এই সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৭২ সালের সংবিধানের মৌলিক কিছু বিষয়ও ফিরিয়ে আনা হয়।

রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসাবে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি সংযোজন করা হয়। সংবিধানে ধর্ম নিরপেক্ষতা এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা পুনর্বহাল করা হয়। তবে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল রাখা হয়।

এই সংশোধনীর মাধ্যমেই মুক্তিযুদ্ধের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পিতা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাদ দেওয়া ‘আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ – এই শব্দ-গুচ্ছ সংবিধানে পুনঃ-স্থাপন করার দাবিতে বাংলাদেশের কয়েকটি ইসলাম পন্থী দল যুগ্মভাবে হরতালের ডাক দেয়। এই কর্মসূচিতে বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশও তাদের সমর্থন জানায়।

শেয়ার করুন

তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল-ধর্মনিরপেক্ষতা, পঞ্চদশ সংশোধনী ঘিরে যা ঘটেছিল

সময় : ১২:৪৯:৪৩ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৪

সংবিধানের যে সংশোধনীর মাধ্যমে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করাসহ বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছিল, বাংলাদেশের আদালতে বর্তমানে সেই পঞ্চদশ সংশোধনীর বিরুদ্ধে রিটের শুনানি চলছে। ১৩ বছর পর আবার নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরবে কি-না, তা নির্ধারণ হতে পারে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে।

দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের পর ২০১১ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে জাতীয় সংসদে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলসহ সংবিধানে বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছিল।

আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামীসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর দাবিতে ১৯৯৬ সালে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে বিধান আনা হয়েছিল, আওয়ামী লীগের প্রস্তাবেই ২০১১ সালের ৩০ জুন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সেটি বাতিল বাদ দেওয়া হয়।

ওইদিনই এর বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে তৎকালীন জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া বলেছিলেন, জনমতকে উপেক্ষা করে একতরফাভাবে সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে দেশকে অনিবার্য সংঘাতের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বয়কট করেছিল বিএনপিসহ বাংলাদেশের অনেক রাজনৈতিক দল।ওই নির্বাচন বাতিলের দাবিতে হরতাল, অবরোধসহ নানা রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনাও ঘটেছিল বাংলাদেশে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার যেভাবে সংবিধানে

বাংলাদেশে প্রথম কোন তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কার্যক্রম দেখা যায় ১৯৯০ সালে সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের পতনের পর। তখন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদ একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্ব দিলেও সংবিধানে এরকম কোন ব্যবস্থা ছিল না।

১৯৯৪ সালে বিএনপি ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় মাগুরার একটি আসনের উপনির্বাচনে ভোট কারচুপির অভিযোগে দেশে নানা সমালোচনা হয়। তখন নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা চালুর দাবিতে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছিল তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামীসহ অনেক রাজনৈতিক দল।

বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর বয়কট ও প্রতিবাদ উপেক্ষা করে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপি সরকার নির্বাচন আয়োজন করে সরকার গঠন করলেও আন্দোলনের মুখে ক্ষমতায় টিকতে পারেনি।

বিরোধীদের দাবি মেনে সেই ষষ্ঠ সংসদে একদিনের এক অধিবেশনে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধন আনা হয়। তাতে সংবিধানের ২(ক) পরিচ্ছদে যুক্ত হয় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। পরে ওই বছরই জুনে দেশে প্রথমবারের মতো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয় সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তারপর ২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় নির্বাচনও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়।

কিন্তু ২০০৬ সালে বিচারপতি কে এম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান বানানো নিয়ে বাংলাদেশে এক ধরনের সহিংস রাজনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি হয়। যার প্রেক্ষিতে সংকটকালীন অবস্থায় ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশে জরুরি অবস্থা জারি হয়। ক্ষমতায় বসে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবয়াক সরকার। যেটি বাংলাদেশে ‘ওয়ান ইলেভেন’ সরকার নামেও পরিচিত ছিল।

ওই সরকার প্রায় দুই বছর পর ২০০৮ সালের ২৯শে ডিসেম্বর নির্বাচন আয়োজন করে। ওই নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ।

তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল

ত্রয়োদশ সংশোধনীর পাসের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দুটি মামলা হলেও হাইকোর্ট সেগুলো খারিজ করে দেন। কিন্তু হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়েছিল। এরপর ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণের পর তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকসহ সাত বিচারপতির আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ আপিলের শুনানি করে ২০১১ সালের ১০ই মে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী অসাংবিধানিক ঘোষণা করে সংক্ষিপ্ত, বিভক্ত আদেশ দেন সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতিরা।

আদালতের এই রায়কে সেদিন স্বাগত জানায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। আর সংসদের তৎকালীন বিরোধী দল বিএনপি তাদের প্রতিক্রিয়ায় জানায়, আদালতের ওই রায়ের ফলে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সাংবিধানিক সংকট তৈরি হতে পারে। তখন আদালত যে রায় দিয়েছিল সেখানে বলা হয়, পরবর্তী দুটি নির্বাচন পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে। সেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে বিচারপতিদের রাখার বিষয়টি সংসদের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়। এর মাস দেড়েকের মাথায় একই বছরের ৩০শে জুন জাতীয় সংসদে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আনা হয়। এর মধ্য দিয়ে স্থায়ীভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হয়ে যায়।

তৎকালীন বিরোধী দল বিএনপির অনুপস্থিতিতে এই সংশোধনী পাশ হয় সংসদে। এই সংশোধনীতে নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করার কথা বলা হয়। সেই সময় সংসদ ভেঙে না গেলেও কোন অধিবেশন বসবে না বলেও সংশোধনী আনা হয়। এ ছাড়া সংশোধনী অনুযায়ী রাজনৈতিক সরকার শুধু রাষ্ট্রের রুটিন কাজ করবে বলেও বিধান রাখা হয়।

পঞ্চদশ সংশোধনী নিয়ে বিতর্ক

সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর পর এ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্ক জোরালো হয়ে ওঠে। আওয়ামী লীগ ও সমমনা দলগুলো একে স্বাগত জানালেও বিরোধী দলগুলো তীব্র আপত্তি জানায়।
পরদিন দৈনিক খবরের কাগজগুলোতে পঞ্চদশ সংশোধনী বিষয়ে বিএনপির প্রতিক্রিয়া, আওয়ামী লীগের অবস্থানসহ নানা খবর প্রকাশিত হয়।

সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধী দলের উদ্দেশ্যে সংসদে বলেছিলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিয়ে কোনো ফর্মুলা থাকলে বলতে পারেন। অহেতুক জনগণকে কষ্ট দেবেন না। অযথা গণ্ডগোল পাকাবেন না।

সংসদে বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাশের পর তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায় বিএনপি।
প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছিলেন, নিরপেক্ষ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের সব সম্ভাবনা তিরোহিত হলো। এই অপচেষ্টায় দেশে সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠল। গণতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ পন্থায় ক্ষমতা হস্তান্তরের সব পথ রুদ্ধ হয়ে গেল।

ওই সংক্ষিপ্ত আদেশের ১৬ মাস পরে ২০১২ সালের ১৬ই সেপ্টেম্বর যখন পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয় তখন এ বি এম খায়রুল হক প্রধান বিচারপতি পদ থেকে অবসর নেন। তিনি যে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন তাতে পরবর্তী দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা থাকার বিষয়টি ছিল না। এমনকি, সরকারের মেয়াদ শেষ হলেও সংসদ বহাল থাকার কথাও যুক্ত হয় পূর্ণাঙ্গ রায়ে। সংক্ষিপ্ত রায়ের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ রায়ের এই বিশাল অসংগতি নিয়ে তখনই জোরালো বিতর্ক উঠেছিল।
পূর্ণাঙ্গ রায়ে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের সঙ্গে একমত হয়েছেন বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন, বিচারপতি এস কে সিনহা এবং বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন।

আরো পড়ুনঃক্রীড়াঙ্গনে দুর্নীতি হলে খতিয়ে দেখবে মন্ত্রণালয়
রায়ের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে মত দেন বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা। তার সঙ্গে একমত পোষণ করেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা। তবে বিচারপতি মো. ইমান আলী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে বা বিপক্ষে মত না দিয়ে বিষয়টি জাতীয় সংসদের ওপর ছেড়ে দেন।

পঞ্চদশ সংশোধনী ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ

২০১১ সালের ৩০শে জুন জাতীয় সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী আনার দিন সংসদে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের ৩৯ জন ও এলডিপির একজন সংসদ সদস্য সেদিন সংসদে যাননি। তখন সংসদে একমাত্র স্বতন্ত্র সদস্য ফজলুল আজিম বিপক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। আর পক্ষে ভোট পড়েছিল ২৯১টি।

এই পঞ্চদশ সংশোধনী বিলটি তৎকালীন আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ সংসদে এনেছিলেন ২০১১ সালের জুন মাসে।
পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে শুধু তত্ত্বাধায়ক সরকার বাতিলই হয় নি, এই সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৭২ সালের সংবিধানের মৌলিক কিছু বিষয়ও ফিরিয়ে আনা হয়।

রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসাবে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি সংযোজন করা হয়। সংবিধানে ধর্ম নিরপেক্ষতা এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা পুনর্বহাল করা হয়। তবে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল রাখা হয়।

এই সংশোধনীর মাধ্যমেই মুক্তিযুদ্ধের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পিতা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাদ দেওয়া ‘আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ – এই শব্দ-গুচ্ছ সংবিধানে পুনঃ-স্থাপন করার দাবিতে বাংলাদেশের কয়েকটি ইসলাম পন্থী দল যুগ্মভাবে হরতালের ডাক দেয়। এই কর্মসূচিতে বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশও তাদের সমর্থন জানায়।