বাংলাদেশে ধর্মীয় স্বাধীনতা নিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিবেদন যা বলল
- সময় : ০৬:০২:৩৭ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২০ অগাস্ট ২০২৪
- / ১৩ বার দেখেছে
বাংলাদেশে ধর্মীয় স্বাধীনতা নিয়ে বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর। ২০২৩ সালের এ প্রতিবেদনে ধর্ম পালনের ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতা ও বৈষম্যের দিক তুলে ধরা হয়েছে।
বাংলাদেশের সংবিধানে ইসলামকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে ঘোষণা করা হলেও ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিকে সমুন্নত রাখা হয়েছে। নিষিদ্ধ করা হয়েছে ধর্মীয় বৈষম্য। বলা হয়েছে, সব ধর্মের মানুষের জন্য সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার কথা। দেশটিতে বিভিন্ন ধর্মের জন্য রয়েছে আলাদা পারিবারিক আইন।
আহমদিয়া সম্প্রদায়ের নেতারা বলেছেন, আহমেদনগরে গত বছরের (২০২৩) মার্চে তাঁদের বার্ষিক সম্মেলনে শত শত লোক হামলা চালান। এ সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও অন্য সরকারি কর্মকর্তারা পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সহিংসতায় দুজনের মৃত্যু হয়, আহত হন অনেকে, আহমদিয়া সম্প্রদায়ের কয়েক শ বাড়িঘরে লুটতরাজ ও ভাঙচুর চালানো হয়। হামলা চালানো হয় আহমদিয়াদের একটি মসজিদ ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রেও।
ওই ঘটনার পর পুলিশ কয়েক হাজার অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করে। গ্রেপ্তার করা হয় সহিংসতার কথিত উসকানিদাতারাসহ দুই শতাধিক ব্যক্তিকে। ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতারা অব্যাহতভাবে বলেছেন, মুসলিম জনগোষ্ঠীর ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার কারণে’ ধর্মীয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠী, বিশেষ করে হিন্দুধর্মের লোকজনকে নিশানা করে সরকার প্রায়ই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো আইনের প্রয়োগ করেছে।
অধিকাংশ ঘটনায় ফেসবুকে কথিত অবমাননাকর মন্তব্য করায় ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। যদিও প্রতিশোধমূলক সহিংসতার ঘটনার নেপথ্যে থাকা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তেমনটা নেওয়া হয়নি।
মুসলিম ধর্মীয় নেতারা বলেন, সরকার মসজিদে ইমাম নিয়োগ ও অপসারণে প্রভাব খাটিয়ে গেছে। দেশজুড়ে ইমামেরা তাঁদের খুতবায় কোন বিষয়বস্তু তুলে ধরবেন, এ বিষয়েও নির্দেশনা দিয়েছে সরকার।
এদিকে মুসলিম ধর্মীয় নেতারা বলেছেন, সরকার মসজিদে ইমাম নিয়োগ ও অপসারণে প্রভাব খাটিয়ে গেছে। দেশজুড়ে ইমামেরা তাঁদের খুতবায় কোন বিষয়বস্তু তুলে ধরবেন, এ বিষয়েও নির্দেশনা দিয়েছে সরকার।
গত সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্বার্থরক্ষায় সরকারের দেওয়া নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণ, জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তায় বিশেষ আইন কার্যকর করা, সরকারি চাকরিতে তাঁদের জন্য কোটা সংরক্ষণের ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনাসহ বিভিন্ন দাবিতে অনশন কর্মসূচি ঘোষণা করে।
এ কর্মসূচির প্রতিক্রিয়ায় সরকার অক্টোবরের মধ্যে একটি জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন ও ২০১৮ সালের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণ করার ঘোষণা দেয়; কিন্তু বছর শেষ হওয়ার আগপর্যন্ত এসব বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি সরকার।
বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে জড়ানোর অভিযোগে এক নারীকে বেত্রাঘাত ও পাথর নিক্ষেপের ফতোয়া দেওয়ায় গত বছরের এপ্রিলে একজন ইসলামি-বিশেষজ্ঞ ও তিনজন গ্রামপ্রধানের বিরুদ্ধে আইনভঙ্গের অভিযোগ আনা হয়। দেশে সহিংসতার ঘটনার ওপর নজরদারি করা সংগঠনগুলোর একটির হিসাব অনুযায়ী, গত বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ২২টি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় ১ জন নিহত ও ৮১ জন আহত হয়েছেন।
মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠন (এনজিও) ও কয়েকজন ধর্মীয় নেতা ইসলাম ও হিন্দুধর্ম থেকে খ্রিষ্টধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়া ব্যক্তিদের হয়রানি, সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন ও শারীরিক নির্যাতন করার অভিযোগ করেছেন।
ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রতি সরকারের শ্রদ্ধাবোধের মাত্রা
বাংলাদেশের সংবিধানে ইসলামকে রাষ্ট্রীয় ধর্মের স্বীকৃতি দেওয়া হলেও হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্ট ও অন্যান্য ধর্মের মানুষের জন্য সমমর্যাদা ও সমানাধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে।
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানে, এমন ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও ক্ষতিকর’ বক্তব্য এবং কর্মকাণ্ডের জন্য জরিমানা বা দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের সাজা রাখা হয়েছে দণ্ডবিধিতে। তবে এই নিষিদ্ধ বিষয়বস্তুর ব্যাখ্যা দণ্ডবিধিতে নেই। সরকারকে ‘নাগরিকদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টিকারী বা ধর্মীয় বিশ্বাসের জন্য অবমাননাকর’ ভাষা ব্যবহার করা সংবাদপত্র, সাময়িকী বা অন্য প্রকাশনার সব কপি জব্দ করার অনুমতি দিয়েছে ফৌজদারি আইন। অনলাইন প্রকাশনার ক্ষেত্রেও একই বিধিনিষেধ এ আইনে আরোপ করা হয়েছে।
দেশে নির্দিষ্ট কোনো ব্লাসফেমি আইন না থাকলেও ইসলাম ধর্ম ক্ষুণ্নকারী কর্মকাণ্ডের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তি আইন ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ব্যবহার করে থাকে কর্তৃপক্ষ।
সহিংসতায় দায়ী ব্যক্তিদের সাজা দিতে ব্যর্থতা
২০২১ সালে দুর্গাপূজার উৎসব চলাকালে হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সহিংসতার ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের যথাযথ সাজা দিতে ব্যর্থতার অভিযোগে সরকারের সমালোচনা করে আসছেন হিন্দু নেতারা। তবে তাঁরা উল্লেখ করেন, ২০২৩ সালের দুর্গাপূজা সামনে রেখে সরকার অতিরিক্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য মোতায়েন, ধর্মীয় সম্প্রীতি উৎসাহিত করতে আন্তধর্মীয় সংলাপ আয়োজনের মতো পদক্ষেপ নিয়েছে। সেবারের উৎসবে কোনো সাম্প্রদায়িক সহিংসতার খবর পাওয়া যায়নি।
সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের আটক
গত বছরের ২৭ মার্চ রাজধানীর গুলশানে পবিত্র কোরআন শিক্ষার একটি কেন্দ্র থেকে পুলিশ ১৭ জনকে আটক করে। তাঁরা পবিত্র রমজান মাসে নিয়মিত রাত্রিকালীন প্রার্থনায় অংশ নিয়েছিলেন। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, পরে আরও চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের মধ্যে পরিবারের সদস্যরাও ছিলেন; যাঁরা বন্দী স্বজনদের জন্য খাবার নিয়ে গিয়েছিলেন।
নারী-শিশুসহ আটক এসব ব্যক্তির বিষয়ে পুলিশ বলেছে, তাঁরা জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ও সরকারের বিরুদ্ধে নাশকতার পরিকল্পনা করছিলেন। এ ঘটনায় দলটির ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল বলেন, পুলিশ আটক ব্যক্তিদের কারও কারও বাসা থেকে বিস্ফোরক সামগ্রী উদ্ধারের দাবিও করেছে; যা হাস্যকর।
ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে নিয়ন্ত্রণ, সংখ্যালঘুদের প্রতি ‘বৈষম্য’ ও অন্যান্য
জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমসহ হাজার হাজার মসজিদ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের আওতায় পরিচালিত হয়। এ ফাউন্ডেশন ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অধীন। এসব মসজিদের ইমাম ও কর্মীর বেতন হয় সরকারি অর্থায়নে। ইসলামিক ফাউন্ডেশন এসব মসজিদের দেখভাল করে না; তা করে পরিচালনা কমিটিগুলো। এসব কমিটির নিয়ন্ত্রণে থাকেন ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতা-কর্মী ও প্রশাসকেরা।
মসজিদের ইমামদের নিয়োগ ও অপসারণে থাকে সরকারের নিয়ন্ত্রণ। দেশজুড়ে ইমামদের খুতবা প্রদানের বিষয়েও নির্দেশনা দিয়ে থাকে সরকার। ধর্মীয় নেতারা বলেছেন, সব মসজিদের ইমামই সাধারণত সরকারি নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক খুতবা এড়িয়ে চলেন।
গত জুনে এক সংবাদ সম্মেলনে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ অভিযোগ করে, প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেটে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য যে বরাদ্দ, তা তাদের প্রতি ‘অসম্মান, অবহেলা ও বৈষম্যের’ পরিষ্কার প্রমাণ। কেননা, ধর্মীয় খাতে বরাদ্দের বড় অংশ যাচ্ছে ইসলামিক ফাউন্ডেশনে। এক বিবৃতিতে এই পরিষদের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কল্যাণে বরাদ্দ ধর্ম মন্ত্রণালয়ের বাজেটের মাত্র ৬ দশমিক ৪ শতাংশ।
গত অক্টোবরে দুই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং ঐক্য পরিষদ তাদের সদস্যদের ওপর হামলার ঘটনায় ৫০০ ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করে। এ সদস্যরা কুমিল্লায় আয়োজিত একটি বিক্ষোভে অংশ নিচ্ছিলেন। পরিষদ বলেছে, হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের আক্রমণাত্মক মন্তব্য, কুড়িগ্রামে একজন হিন্দু কবির ওপর হামলা ও ২০২১ সালে দুর্গাপূজায় কুমিল্লায় মন্দির ভাঙচুরের ঘটনার প্রতিবাদে তারা ওই বিক্ষোভ আয়োজন করেছিল। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, গ্রেপ্তার দুজন ও যাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়, তাঁরা ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র ও যুবসংগঠনের সদস্য।
ঢাকায় গত বছরের ১৯ জুন এক সংবাদ সম্মেলনে একটি নারী সংগঠন যেসব মুসলিম নারী নেকাব পরা পছন্দ করেন, তাঁদের জন্য জাতীয় পরিচয়পত্রে ছবির বিষয় ঐচ্ছিক রাখার ব্যাপারে সরকারের কাছে অনুরোধ জানায়। সংগঠনটি বলেছে, যেসব নারী নেকাব সরাতে অস্বীকার করেছেন, তাঁদের পরিচয়পত্র না দেওয়া মানবাধিকারের লঙ্ঘন।
সংগঠনটির আহ্বান ছিল, ওই নারীদের পরিচয় শনাক্তে আঙুলের ছাপ বা চোখের আইরিস স্ক্যান ব্যবহার করার। তা ছাড়া কর্তৃপক্ষ যদি তাঁদের মুখমণ্ডল দেখতে চায়, সে ক্ষেত্রে ঘরোয়া বৈঠকে নারী কর্মকর্তাদের দিয়ে তা যাচাই করা যেতে পারে।
হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ও অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যরা তাঁদের সম্পত্তি ও ভূমির মালিকানা নিয়ে বিবাদ, জোরপূর্বক উচ্ছেদের মামলাগুলো বছর শেষেও অনিষ্পন্ন থাকার কথা বলেছেন। এসব মামলার কোনো কোনোটিতে সরকার সংশ্লিষ্ট রয়েছে। কিছু মানবাধিকারকর্মী বলেছেন, এসব বিবাদ ও জোরপূর্বক উচ্ছেদের ঘটনা ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সরকারের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বৈষম্য, নাকি সরকারের অদক্ষতার ফল, তা নির্ণয় করা প্রায়ই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
ফ্রিডম হাউসের ‘ফ্রিডম ইন দ্য ওয়ার্ল্ড ২০২৩ রিপোর্টে’ বাংলাদেশ-সম্পর্কিত মূল্যায়নে বলা হয়, রাজনীতিতে ও সরকারি সংস্থায় ধর্মীয়, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও অন্যান্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব সীমিতই রয়ে গেছে।
ধর্মীয় স্বাধীনতায় প্রভাব ফেলা আরও কিছু বিষয়
গণমাধ্যমের খবর ও সরকারি তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের জুনে বাংলাদেশ থেকে ১ লাখ ২২ হাজারের বেশি মুসল্লি পবিত্র হজ পালন করেন। তাঁদের বেশির ভাগই যান বেসরকারি এজেন্সিগুলোর মাধ্যমে। ধর্ম মন্ত্রণালয় পুরো প্রক্রিয়া তদারক করে।
স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো জানায়, সরকারি বিমান সংস্থায় ভ্রমণসহ হজ প্যাকেজে এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি অর্থ আদায় করা হয়েছে। সমালোচনার মুখে ওই বছরের মার্চে ধর্ম মন্ত্রণালয় বিমান সংস্থাকে উড়োজাহাজের ভাড়া কমানোর নির্দেশনা দেয়। বিমান সংস্থা জানায়, ২০২৩ এর হজযাত্রীদের জন্য তারা সেটি করতে পারবে না।
এ অবস্থায় হজযাত্রীদের ওই বছর ৬ হাজার ৩০০ ডলারের (১১০ টাকা হিসেবে ৬ লাখ ৯৩ হাজার টাকা) মতো খরচ করতে হয়েছে। এটি এর আগের বছরের তুলনায় ১ হাজার ৪৫০ ডলারের মতো বেশি।