৭ শতাংশ কোটা পদ্ধতিতেও আসছে সংস্কার বড়তে পারে শতাংশ
- সময় : ০৩:৫৪:০৫ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৯ অক্টোবর ২০২৪
- / ৮২ বার দেখেছে
কোটা সংস্কার আন্দোলন বদলে দিয়েছে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন। তুমুল ছাত্র আন্দোলনের মুখে টানা প্রায় ১৬ বছরের শাসক শেখ হাসিনাকে হারাতে হয়েছে ক্ষমতার মসনদ। ছাত্র-জনতার তোপের মুখে শেষ সময়ে সরকারি চাকরিতে ৭ শতাংশ কোটা ব্যবস্থা চালু করতে বাধ্য হয় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। তবে সেই পদ্ধতিতেও সায় দেননি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। এখনো তারা কোটার যৌক্তিক সংস্কারের পথেই হাঁটছেন।
হাসিনা সরকারের পতনের পর দায়িত্ব নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। যদিও নতুন সরকার পুরোদমে এখনো সরকারি চাকরির নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেনি। তবে সামনে ৪৭তম বিসিএসসহ বিভিন্ন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ঘিরে আবারও আলোচনায় আসছে কোটা বণ্টন পদ্ধতি। আওয়ামী লীগ সরকারের রেখে যাওয়া ৭ শতাংশ কোটার বিধানই বহাল থাকবে নাকি তাতে পরিবর্তন আসবে; তা নিয়ে ভেতরে ভেতরে চলছে আলোচনা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা চান কোটার যৌক্তিক সংস্কার। সেক্ষেত্রে ৭ শতাংশের জায়গায় আরও কিছু বাড়ানোর পক্ষে তারা। পাশাপাশি নারী কোটা এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্যও কোটা রাখার পক্ষে সমন্বয়করা। তবে বীর মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৫ শতাংশ থাকবে নাকি তা আরও কমবে—তা নিয়েও রয়েছে আলোচনা।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, বিষয়টি নিয়ে এক দফা কিছুটা আলোচনা হয়েছে। তবে সেটা খুবই প্রাথমিক। যদি শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে অর্থাৎ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা বিষয়টি নিয়ে কোনো প্রস্তাব দেন, তা সরকার বিবেচনা করবে এবং দ্রুত বাস্তবায়ন সম্ভব হবে।
সরকারি চাকরিতে কোটা বণ্টন: ২০১৮ থেকে ২০২৪
২০১৮ সাল পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা প্রচলিত ছিল। ওই বছর ঢাকাসহ সারাদেশে শিক্ষার্থীরা বৈষম্য নিরসনের দাবিতে আন্দোলনে নামেন। সেসময়ও তারা কোটার যৌক্তিক সংস্কার দাবি করেন। তবে সেই পথে না হেঁটে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোটা পুরোপুরি তুলে দেওয়ার ঘোষণা দেন। রাগ বা ক্ষোভের বশে তিনি ওই ঘোষণা দিয়েছিলেন বলে পরে স্বীকারও করেন।
তবে ঘোষণা অনুযায়ী—২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর সরকারি চাকরিতে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদে (৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড) নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থা বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে।
২০১৯ সালের ৩০ জুলাই তৎকালীন সরকার জানায়, সরকারি চাকরিতে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো কোটা আর বহাল নেই। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির পদে (১৪তম থেকে ২০তম পর্যন্ত) কোটা বহাল রয়েছে। তবে সংশ্লিষ্ট কোটার প্রার্থী না পাওয়া গেলে সাধারণ প্রার্থীর মেধাতালিকা থেকে তা পূরণ করতে হবে।
২০২০ সালের ২০ জানুয়ারি কোটার বিষয়ে আগের (২০১৮ সালের) জারি করা পরিপত্র স্পষ্ট করা হয়। পাশাপাশি মন্ত্রিসভার বৈঠকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দেওয়া সরকারি চাকরিতে অষ্টম বা তার ওপরের পদেও সরাসরি নিয়োগে কোটা বাতিলের প্রস্তাব অনুমোদন হয়।
এদিকে, মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহালের দাবিতে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের পক্ষে অহিদুল ইসলাম তুষার নামে এক ব্যক্তি উচ্চ আদালতে ২০২১ সালে একটি রিট করেন। রিটের শুনানি শেষে বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের ও বিচারপতি খিজির হায়াতের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ গত ৫ জুন ২০১৮ সালের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করেন। এতে সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাসহ ৫৬ শতাংশ কোটা ব্যবস্থা পুনরায় ফিরে আসে।
সব সময় আমরা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা সবশেষ প্রজ্ঞাপন অনুসরণ করি। সেক্ষেত্রে ২৩ জুলাই, ২০২৪ তারিখের প্রজ্ঞাপন সবশেষ। সেটাই আমরা অনুসরণ করবো। যদি মন্ত্রণালয় থেকে কোনো নির্দেশনা আসে, সেক্ষেত্রে সেটা মানা হবে।- পিএসসির পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক আনন্দ কুমার বিশ্বাস
ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন শিক্ষার্থীরা। ওইদিন থেকেই ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, জগন্নাথ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী আন্দোলনে নামেন। তারা ২০১৮ সালে কোটা বাতিল করে দেওয়া পরিপত্র পুনর্বহালেরর দাবি জানান। একই সঙ্গে কোটা ব্যবস্থার যৌক্তিক সংস্কারের দাবি করেন।
তুমুল আন্দোলনে কার্যত অচল হয়ে পড়ে দেশ। জারি করা হয় কারফিউ। ২১ জুলাই সুপ্রিম কোর্ট ৭ শতাংশ কোটা রেখে রায় ঘোষণা করেন। ফলে মেধার ভিত্তিতে ৯৩ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৫ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কোটায় ১ শতাংশ, প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গ কোটায় ১ শতাংশ প্রার্থী নিয়োগ পাবেন।
যৌক্তিক সংস্কারের পক্ষে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন
কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তৎকালীন সরকারের দমন-পীড়নে তা রূপ নেয় সরকার হটাও আন্দোলনে। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর কার্যত দেশের দায়ভার চলে যায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কাঁধে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিলেও নানান কাজে ব্যস্ত এ সংগঠনের সমন্বয়করা। ফলে কোটা সংস্কারের বিষয়টি অনেকটা আড়ালে চলে যায়।
সম্প্রতি সাংবাদিক খালেদ মহিউদ্দিনের টকশোতে এ নিয়ে কথা বলেন সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ। ৭ শতাংশ কোটা তারা মেনে নিয়েছেন কি না, এমন প্রশ্নে তিনি জানান, তারা আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্ত মেনে নেননি। কোটার যৌক্তিক সংস্কার চান।
জানতে চাইলে হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, ‘পতিত আওয়ামী লীগ সরকার বাধ্য হয়ে আজ্ঞাবহ সুপ্রিম কোর্ট বসিয়ে ৭ শতাংশ কোটা পদ্ধতি দিয়ে যায়। তারপর আমরা ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলন করেছিলাম। সেখানে নাহিদ হাসান ও সারজিস আলমও ছিলেন। তখন তো আমরা ৭ শতাংশ কোটা বণ্টন পদ্ধতি প্রত্যাখ্যান করেছিলাম। কারণ আওয়ামী লীগ নারী, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীসহ অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা না করে এটা করেছিল।’
বিভিন্ন ইস্যুর ব্যস্ততায় কোটা পদ্ধতির সবশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে ভালোভাবে অবগত নন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘কোটা নিয়ে কোনো কাজ চলছে কি না, সেটা নিয়ে আমি আপডেটেড নই। আমরা মনে করি, নারীদের বাদ দেওয়া হয়েছে, প্রান্তিক জনপদের পিছিয়ে পড়া মানুষদের বাদ দেওয়া হয়েছে; এটা যৌক্তিক নয়। কোটা বণ্টনে আরও যৌক্তিক সংস্কার দরকার। প্রয়োজনে বাড়ানোও যেতে পারে।’
কোটা পদ্ধতি নিয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত চায় পিএসসি
নভেম্বরে ৪৭তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি হবে। এ নিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। কোটা পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনার চিন্তা-ভাবনা থাকলে তা দ্রুত করা উচিত বলে মনে করেন কমিশনের কর্মকর্তরা। শুধু বিসিএস নয়, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক, পুলিশের এসআই, ভূমি অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিয়োগের আগে বিষয়টির সুরাহা করা উচিত বলে একমত সংশ্লিষ্টরা। তা না হলে আইনি জটিলতায় পড়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া থমকে যেতে পারে।
পিএসসির পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (ক্যাডার শাখা) আনন্দ কুমার বিশ্বাস আপনার বার্তাকে বলেন, ‘সব সময় আমরা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা সবশেষ প্রজ্ঞাপন অনুসরণ করি। সেক্ষেত্রে ২৩ জুলাই, ২০২৪ তারিখের প্রজ্ঞাপন সবশেষ। সেটাই আমরা অনুসরণ করবো। যদি মন্ত্রণালয় থেকে কোনো নির্দেশনা আসে, সেক্ষেত্রে সেটা মানা হবে। যেহেতু একটি বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি আসন্ন, তাই ৭ শতাংশ কোটায় যদি পরিবর্তন আনার চিন্তা-ভাবনা থাকে সেটা দ্রুত করা গেলে ভালো হবে।’
সুপ্রিম কোর্টের রায় মেনে ওই সময় (২৩ জুলাই) প্রজ্ঞাপন হয়েছিল। এটাতে পরিবর্তন আনতে হলে আবার আইনি প্রক্রিয়ার প্রয়োজন আছে কি না, সেটাও আলাপ করে দেখতে হবে। বিষয়টি নিয়ে সরকারের ঊর্ধ্বতনরা কোনো নির্দেশনা দিলে তখন আমরা দেখবো।- অতিরিক্ত সচিব মো. আব্দুর রউফ
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পলিসি অ্যান্ড অপারেশন্স বিভাগের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে আপনার বার্তাকে বলেন, ‘তৃতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ নিয়ে আমরা আটকে আছি। কোটা পদ্ধতি কোনটা মানতে হবে, সেটা জানতে আইন মন্ত্রণালয়ে চিঠিও দেওয়া হয়েছে। তারা মতামত পাঠালে তা মেনে কাজ করা হবে। তার মধ্যেই আবারও পরিবর্তন হলে ঝামেলা আরও বাড়বে। সেজন্য দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলে প্রার্থীরা উপকৃত হবে, আমাদেরও কাজ করতে সুবিধা হবে।’
দ্রুত এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে একমত হাসনাত আব্দুল্লাহও। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এতদিন সরকারি চাকরির তেমন সার্কুলার ছিল না। এখন যেহেতু বিসিএসসহ বিভিন্ন জায়গায় সার্কুলার হবে, সেক্ষেত্রে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এটা বাস্তবায়নে দীর্ঘ সময় লাগবে, এটা বলা যাবে না।’
কোটা সংস্কারে ইতিবাচক সরকার, চলছে আলোচনা
৭ শতাংশ কোটা পদ্ধতিতে পরিবর্তন নিয়ে সরকারও ইতিবাচক বলে জানিয়েছেন খোদ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাও। তাদের ভাষ্য, বিষয়টি নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা যত দ্রুত প্রস্তাব দেবেন, তত দ্রুত এটা করা সম্ভব হবে। বাস্তবতা হলো—তাদের দেওয়া রূপরেখায় সরকার বাস্তবায়ন করবে।
কোটা পদ্ধতিতে আবারও সংস্কার আনার বিষয়টি গণমাধ্যমে কথা বলতে নারাজ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ বিভাগের একজন কর্মকর্তা নাম ও পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে আপনার বার্তাকে বলেন, ‘এটা নিয়ে কিছু আলাপ-আলোচনা হয়েছিল। নানা ব্যস্ততায় তা এগোয়নি। শিক্ষার্থীরা চাইলে হয়তো দ্রুত সেটা নিয়ে কাজ শুরু হবে। সম্ভবত কোটা কিছুটা বাড়তে পারে।’
একই মন্ত্রণালয়ের সংস্কার ও গবেষণা বিভাগের আরেকজন কর্মকর্তা বলেন, ‘যত দূর জানি, শিক্ষার্থীরা…মানে যারা সমন্বয়কের দায়িত্বে রয়েছেন তারা নারী, পিছিয়ে পড়া জেলা কোটা, মাইনরিটিসহ কিছু কোটা বাড়াতে চান। সেক্ষেত্রে কোটা ১০ শতাংশ বা তার বেশিও হতে পারে। আবার মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কোটা ৫ শতাংশের জায়গায় কিছুটা কমিয়ে অন্য কোটার জন্য বরাদ্দ দেওয়ার আলোচনাও রয়েছে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হলে সেটা সবাইকে জানানো হবে।’
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. আব্দুর রউফ আপনার বার্তাকে বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের রায় মেনে ওই সময়ে (২৩ জুলাই) প্রজ্ঞাপন হয়েছিল। এটাতে পরিবর্তন আনতে হলে আবার আইনি প্রক্রিয়ার প্রয়োজন আছে কি না, সেটাও আলাপ করে দেখতে হবে। বিষয়টি নিয়ে সরকারের ঊর্ধ্বতনরা কোনো নির্দেশনা দিলে তখন আমরা দেখবো।’
আইনগত দিক নিয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার অনীক আর হক আপনার বার্তাকে বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমাদের সরকারের পক্ষ থেকে কিছু বলা হয়নি। এখন এ নিয়ে কিছু বলাও সম্ভব নয়।’