Site icon আপনার বার্তা

সকলের জন্য শিক্ষা: ট্রাম্পের জয় থেকে

ট্রাম্প

ডোনাল্ড ট্রাম্প যে জিততে চলেছেন,সে বিষয়টি অনেক আগে অনুমিত ছিল। বিশেষ করে জো বাইডেন যতদিন তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ততদিন সবাই এটা বিশ্বান করতে শুরু করেছিলেন। বিশেষ করে সিএনএন আয়োজিত প্রথম বিতর্কে বাইডেন যেভাবে ট্রাম্পের কাছে ধরাশায়ী হন তাতে রিপাবলিকান প্রার্থীর জয় নিয়ে লেশমাত্র সন্দেহ ছিল না। বরং বাইডেন সরে গিয়ে কমলা হ্যারিস প্রার্থী হওয়ার কারণে ট্রাম্পের একতরফা জয়ের অভিমুখ ঘুরে যায়। আনুষ্ঠানিকভাবে ডেমোক্র্যাট দলের প্রার্থী হওয়ার পর মাত্র মাস দুয়েক সময় পেয়েছিলেন। এই সময়কালে তিনি ট্রাম্পকে কঠিন লড়াইয়ের মুখে ফেলেছেন বলে মনে হচ্ছিল। জনমত জরিপগুলোতে কমলা সব সময় এগিয়ে ছিলেন। মনে রাখতে এই জরিপগুলো যারা চালাতেন, তারা আগাগোড়া ট্রাম্পের কট্টর বিরোধী। ফলে জরিপের ফল যে ভোট বাক্সে প্রতিফলিত না হওয়ায়, এটা স্পষ্ট যে, জরিপগুলো হয়তো পক্ষপাতের দোষে দুষ্ট ছিল। তবুও অল্প কিছু সময়ের মধ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো একজন আনপ্রেডিক্টেবল ক্যান্ডিডেটকে কিছুটা হলেও ঘোল খাওয়ানোর জন্য কমলা হ্যারিসকে অবশ্যই ধন্যবাদ পেতেই পারেন।

আরো পড়ুনঃ দুই সেকেন্ডের মধ্যে একজনকে চাকরিচ্যুত করবেন ট্রাম্প!

ডোনাল্ড ট্রাম্প যে বেশ ঘাড়ত্যাড়া লোক, তিনি যে অন্য রাজনীতিকদের মতো একেবারেই নন–এটাই তাঁর সবচেয়ে বড় শক্তি। এই লোকটাকে কোনোভাবে মেনে নিতে পারেনি আমেরিকান এস্টাব্লিশমেন্ট ও তাদের সহযোগী সংবাদমাধ্যম। তাঁর সম্পর্কে একটি ইতিবাচক শব্দ ব্যবহার করা হয়নি। বরং তিনি কত ভয়ংকর বারবার এই তথ্য তুলে ধরে মার্কিনিদেরসহ বিশ্ববাসীর সামনে ভয়ের বাতাবরণ তৈরি করা হয়েছে। আসলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে, বিশেষ করে ১৯৯০-পরবর্তী শীতল যুদ্ধের সময় থেকে আমেরিকা ও তাদের ইউরোপিয় মিত্ররা গণতন্ত্রকে একটা নিজস্ব ছাঁচে ফেল দিয়েছিল। এটা তাদের নিজেদের দেশে যেমন প্রযোজ্য, তেমনি অন্যদের ক্ষেত্রেও। এই ছাঁচের বাইরে গিয়ে কেউ কথা বললেই তাঁর গায়ে দেগে দেওয়া হয় নানা বিশেষণ। অথচ প্রগতিশীলতার লেবাস পরে এই গণতন্ত্রীরা হেন অপকর্ম নেই যা করেন এবং চিরকাল একে গণতন্ত্র নামের গঙ্গাজলে ধুয়ে পাপ ও শাপমুক্ত করেছেন। প্রেসিডেন্ট বাইডেনের দৃষ্টিতে পুতিন, শি জিন পিং–সবই একনায়ক, স্বৈরাচরী ফ্যাসিস্ট। কিন্তু তাঁর দেশে যখন ফিলিস্তিনদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি বর্বরতার বিরুদ্ধে বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের জন্য পথে নামে তখন তা ব্যবহার হয় পুলিশি নৃশংসতা। এই যে প্রগতিশীল রাজনীতিকদের দ্বৈত ও দ্বিচারী স্বত্তা, এ থেকেই ট্রাম্পের মতো জনতুষ্টিবাদী নেতাদের জন্ম।

আরো পড়ুনঃ ‘বন্ধু’ ট্রাম্পকে হোয়াইট হাউজ জয়ের অভিনন্দন জানালেন মোদি

কথিত এই প্রগতিশীল রাজনীতিকদের সমর্থক মূলধারার সংবাদমাধ্যম। গত ৮-৯ বছরে ট্রাম্প সম্পর্কে তারা এমন কোনো কথা নেই যা লেখেনি। সেই ট্রাম্প ২০২৪-এর ৫ নভেম্বর ৭ কোটি ৩৫ লাখের বেশি ভোট পেয়েছেন, যা কমলা হ্যারিসের চেয়ে প্রায় ৫০ লাখ বেশি। এখন কী বলবে, এই পত্রিকাগুলো? আমেরিকার অধিকাংশ মানুষ তাদের কথা বিশ্বাস করেনি। মার্কিন ভোটাররা বা সে দেশের তরুণ, কৃষ্ণাঙ্গ, হিস্পানিকরা ট্রাম্প সম্পর্কে তাদের মূল্যায়নে আস্থা রাখতে পারেননি। একজন আমেরিকা প্রবাসী সাংবাদিক তাঁর ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘জিপ র‍্যাংলারে জ্বালানি ভরছিলেন এক শ্বেতাঙ্গ নারী। ট্যাংক ভরে ৬০ ডলার চার্জ করছেলেন ফোন থেকে। অস্ফূট উচ্চারণে ক্ষেদোক্তি করলেন। দুই আঙুলে ভি চিহ্ন দেখিয়ে বললেন, জ্বালানি মূল্য কমবে বলে তিনি আশা করছেন।’ অর্থাৎ ওই নারী বা তাদের আমেরিকানদের কাছে পুতিন বা শি-কে টাইট দেওয়া অথবা ইসরায়েলের সুরক্ষার চেয়ে নিজের জীবনযাত্রার খরচ সামলানো অনেক বড় প্রশ্ন।

নাইন ইলেভেন (আমেরিকায় টুইট টাওয়ারসহ বিভিন্ন স্থানে সন্ত্রাসী হামলা) পরবর্তী বিশ্বে গণতন্ত্রের নামে চালানো হয়েছে যথেচ্ছাচার। কল্পিত শত্রুর মোড়কে কখনো গণতন্ত্র, কখনো মানবাধিকারহরণ, কখনো বিশ্বের জন্য হুমকির কথা বলে যুদ্ধের বেসাতি রপ্তানি করা হয়েছে ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়াসহ বিভিন্ন দেশে। পরিণতিতে আজ গণতন্ত্রই অবিশ্বস্ত হয়ে পড়েছে। এর পেছনে মূলধারার সংবাদমাধ্যম তার দায় অস্বীকার করতে পারে না। প্রগতিশীল বা জনতুষ্ঠিবাদী নামধারী শাসকদের বিভিন্ন সময়ে তাদের মনমতো আখ্যান তৈরিতে সাহায্য করেছে মূলধারার সংবাদমাধ্যম।

গত বছর ২৫ ডিসেম্বর লিখেছিলাম, “মূলধারার সংবাদমাধ্যম এসব নিয়ে এমনিতে বিপদে আছে। এর সাথে যোগ হয়েছে তাদের পছন্দ-অপছন্দের বিষয়টি। এই পছন্দ-অপছন্দ এতটাই প্রকট যে, পাঠকের একটা বড় অংশ প্রথমেই হারাচ্ছে তারা। এই বিষয়টি সুন্দর করে তুলে ধরেছে ব্রিটেনের জনপ্রিয় সাপ্তাহিক দ্য ইকোনমিস্ট। মূলত তাদের আলোচনা আমেরিকা ঘিরে। আমরাও ওর মধ্যে সীমিত থাকব। তবে এখান থেকে রসদ সবাই পাবেন।”

“সাপ্তাহিকটি আমেরিকার মূলধারার পত্রিকা ও টেলিভিশন শো-র ছয় লাখ নমুনা সংগ্রহ করে তা বিশ্লেষণ করেছে। বিশ্লেষণে দেখা গেছে, নমুনার মধ্যে যেগুলো রাজনৈতিক-বিষয়ক, সেখানে সংবাদমাধ্যম মধ্যপন্থী অবস্থান হারিয়ে ফেলছে। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঝুঁকে গেছে ডেমোক্র্যাটদের দিকে। এর ফলে বিশ্বাসযোগ্যতার জায়গাটা হারিয়ে ফেলছে তারা।”

“আগামী বছর দেশটিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের কল্যাণে ইতিমধ্যে আমেরিকা ডেমোক্র্যাট-রিপাবলিকান দুই শিবিরে খাড়াখাড়ি ভাগ হয়ে গেছে। এই ভাগাভাগির খুবই নির্মম ইতিহাস কিন্তু আমেরিকার আছে। সেটা ভিন্ন বিষয়। কিন্তু এই ভাগ হওয়ার কারণে নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট, সিএনএন-এর মতো সংবাদমাধ্যমগুলো তাদের পাঠক ও দর্শক হিসেবে ট্রাম্প তথা রিপাবলিকান সমর্থকদের হারিয়েছে। ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে মঞ্চে আর্বিভূত হয়েই ট্রাম্প সাহেব মূলধারার সব মিডিয়াকে নাকচ করে দিয়েছিলেন ‘অপসাংবাদিকতা’র লেবেল সেঁটে দিয়ে। আমেরিকার পাবলিক কিন্তু সেটা ভালোভাবেই খেয়েছিল। শুধু খেয়েছিল বললে ভুল হবে, এখনো খাচ্ছে। যে কারণে এসব সংবাদমাধ্যম দীর্ঘ দিন ধরে পাঠকের একটি নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।”

দেশে দেশে প্রগতিশীল বা মূলধারার রাজনীতিকদের এই জনবিচ্ছিন্নতার অন্যতম প্রধান কারণ কথায় ও কাজে মিল না থাকা। ফাইল ছবি

ইকনোমিস্টের সেই বিশ্লেষণের আরেকবার প্রমাণ মিলল তৃতীয় দফায় প্রার্থী হয়ে ট্রাম্পের দ্বিতীয়বার বিজয়ী হওয়ার মধ্য দিয়ে। এই ঘটনা কিন্তু শুধু আর আমেরিকায় সীমাবদ্ধ নেই। দেশে দেশে ট্রাম্পের মতো মনোরঞ্জণবাদী বা জনতুষ্টিবাদী নেতারা উঠে আসছেন। তাদের সত্য-মিথ্যার মোড়কে প্রচারের দাপটে কথিত মূলধারার নেতারা পাবলিকের কাছে ভিলেন হতে চলেছেন। আমরা যদি যুক্তরাজ্যে গত সাধারণ নির্বাচনের দিকে তাকাই তাহলে দেখব, লেবার পার্টি জিতবে এটা সবাই জানত। হয়েছেও সেই ফল। কিন্তু তলে তলে দক্ষিণপন্থী রিফর্ম ইউকে পার্টি উঠে এসেছে। আর এই দলের জন্য অনেক বেশি আসনে হেরেছে কনজারভেটিবরা। এখানে মূলধারার রাজনীতিক বলে পরিচিত, যারা প্রচলিত ব্যবস্থায় আস্থা রাখেন তাঁরা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন।

দেশে দেশে প্রগতিশীল বা মূলধারার রাজনীতিকদের এই জনবিচ্ছিন্নতার অন্যতম প্রধান কারণ কথায় ও কাজে মিল না থাকা। নিজের মতো করে যেকোনো ঘটনার আখ্যান তৈরি এবং বেসুরো গলায় যত জোরে তা গেয়ে যাওয়া। আর এতে সংগত করে চলেছে কথিত মূলধারার সংবাদমাধ্যম। কিন্তু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গত ৩০ বছরে সবকিছু ভেঙে নতুন করে বিশ্ব রচনা করেছে–এটা বেমালুম ভুলে গেছেন তারা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং মেসেজিং অ্যাপের মাধ্যমে মূলধারার সংবাদমাধ্যমকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে তরুণরা। বাইডেন সাহেবরা ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার বলে যে বর্বরতাকে মান্যতা দিচ্ছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সেটাই তরুণদের নৃশংস মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে তুলে ধরছে। জনগণের সেবকদের আয়েশি-বিলাসী ও নীতিহীন কাজের নজির কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমই দিচ্ছে।

এজন্য বিগত যৌবনা নেতারা এই মাধ্যমের টুঁটি চেপে ধরার নানা ফন্দিফিকির করছেন। তাঁরা ভুলে গেছেন, কলসবন্দী দৈত্যকে বের করা সহজ, কিন্তু ঢোকান অসম্ভব। ফলে এই কয়েক প্রজন্মের মধ্যে চিন্তার যে ব্যবধান তা দুস্তর, পাড়ি দেওয়ার ক্ষমতা ষাট বা সত্তোরর্ধ নেতাদের নেই। ট্রাম্পের বিজয় সাময়িক এবং তার কারণও পরিস্কার।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে তৈরি দেশ-রাজনৈতিক সীমারেখা-জাতীয়তাবাদ-উগ্র শ্রেষ্ঠত্ববাদ–সবকিছু ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ছে। পৃথিবীটা সাধারণ মানুষের। হাজার হাজার বছর ধরে তাদের নিয়ন্ত্রণের দড়িতে বেধে রাখা হয়েছে। ফাঁস ক্রমশ ঢিলে হচ্ছে। যুদ্ধ বাধিয়ে অনেক মানুষ মারতে পারবেন, এমনকি গোটা বিশ্বকে ধ্বংস করে দিতে পারেন–কিন্তু সাধারণ মানুষকে আর বেশি দিন নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না। মুক্ত বিহঙ্গের মতো উন্মুক্ত আকাশেই সে উড়ে বেড়াবে, এটাই স্বাভাবিক। ট্রাম্পসহ বিশ্বের তাবৎ নেতারা এটা বুঝলেই ভালো।

 

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, ডিজিটাল মিডিয়া, ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন

Original News

Exit mobile version