১১:৫৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পাকিস্তানের সেনাশাসক জিয়ার সেই উড়োজাহাজে কী কারণে বিস্ফোরণ হয়েছিল

রিপোর্টার
  • সময় : ০৭:৪২:৩৮ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২০ অগাস্ট ২০২৪
  • / ২১ বার দেখেছে

পাকিস্তানের সাবেক সেনাশাসক মুহাম্মদ জিয়া-উল-হকছবি: পাকিস্তানভিত্তিক ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া

মুহাম্মদ জিয়া-উল-হককে বিশ্বাস করে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো। সেনাপ্রধান হওয়ার এক বছরের মাথায় জেনারেল জিয়া তাঁর নিয়োগকর্তা ভুট্টোকে ক্ষমতাচ্যুত করেন।

রক্তপাতহীন সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে বিতর্কিত বিচারের মাধ্যমে ভুট্টোকে ফাঁসিতে ঝোলান জিয়া। অবশ্য জিয়ার স্বৈরশাসনেরও অবসান ঘটে ট্র্যাজেডির মধ্য দিয়ে। সামরিক উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে নিহত হন তিনি। উড়োজাহাজ বিধ্বস্তের ঘটনাটি রহস্যঘেরা।

সামরিক জীবন

জিয়ার জন্ম ১৯২৪ সালের ১২ আগস্ট। ব্রিটিশ ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের জলন্ধরের একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে। এলাকাটি এখন ভারতের অন্তর্ভুক্ত।

বাবা মুহাম্মদ আকবর আলী। তিনি অবিভক্ত ভারতের দিল্লিতে আর্মি জেনারেল হেডকোয়ার্টার্সে কাজ করেছেন।

জিয়ার স্কুল-কলেজের শিক্ষা সিমলায়। তিনি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট স্টিফেন’স কলেজ থেকে ১৯৪৩ সালে বিএ পাস করেন। এরপর তিনি দেরাদুনের রয়্যাল ইন্ডিয়ান মিলিটারি একাডেমিতে যোগ দেন। ১৯৪৫ সালে তিনি ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মিতে কমিশন লাভ করেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেন জিয়া। তিনি ১৯৪৫ সালে বার্মা, মালায় ও ইন্দোনেশিয়ায় দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর জিয়ার পরিবার পাকিস্তানে চলে যায়। তিনি ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন।

১৯৬২ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে সামরিক প্রশিক্ষণ নেন জিয়া। ১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের সময় তিনি ১০১ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডের অ্যাসিস্ট্যান্ট কোয়ার্টার মাস্টার ছিলেন।

ব্রিগেডিয়ার পদে থাকাকালে জিয়া ১৯৬৭ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত জর্ডানে পাকিস্তানের সামরিক প্রশিক্ষণ মিশনের প্রধান হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় তিনি ডেপুটি ডিভিশন কমান্ডার ছিলেন। ১৯৭৫ সালে জিয়া লেফটেন্যান্ট জেনারেল হন।

উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে জিয়া-উল-হক নিহত হওয়ার ঘটনা নিয়ে সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরছবি: ডন পত্রিকার স্ক্রিনশট

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চরিত্র জানতেন প্রধানমন্ত্রী ভুট্টো। তাই তিনি সব সময় সামরিক অভ্যুত্থানের আশঙ্কায় থাকতেন। এই আশঙ্কা থেকে তিনি নানা পদক্ষেপ নিচ্ছিলেন। সেনাবাহিনীর সম্ভাব্য হুমকির বিরুদ্ধে প্রাতিষ্ঠানিক রক্ষাকবচ হিসেবে তিনি এফএসএফ নামের একটি আধা সামরিক বাহিনী গঠন করেছিলেন। এফএসএফ হয়ে ওঠে ভুট্টোর ব্যক্তিগত বাহিনী। এই বাহিনীর সদস্যসংখ্যা ১৯৭৬ সাল নাগাদ ১৮ হাজারে পৌঁছে যায়। এই প্রেক্ষাপটে এফএসএফকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতে শুরু করে মূল সশস্ত্র বাহিনী। এ নিয়ে ভুট্টোর প্রতি সশস্ত্র বাহিনীর সন্দেহ-অবিশ্বাস বেড়ে যায়।

১৯৭৬ সালে সেনাপ্রধান টিক্কা খানের উত্তরসূরি নির্বাচনের সময় অনেক হিসাব-নিকাশ করে জিয়াকেই বেছে নেন ভুট্টো। সাতজন জ্যেষ্ঠ লেফটেন্যান্ট জেনারেলকে ডিঙিয়ে জিয়াকে সেনাপ্রধান করা হয়। তাঁকে সেনাপ্রধান না করতে পরামর্শ দিয়েছিলেন টিক্কা খান। তাঁর সুপারিশ ছিল লেফটেন্যান্ট জেনারেল মুহাম্মদ আকবর খানের জন্য। জ্যেষ্ঠতার ক্রমে তিনি তৃতীয় স্থানে ছিলেন। কিন্তু জিয়াকেই নিজের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ ভেবেছিলেন ভুট্টো। চার তারকার জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে জিয়াকে চিফ অব আর্মি স্টাফ হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। ১৯৭৬ সালের ১ মার্চ তিনি পাকিস্তানের সেনাপ্রধানের দায়িত্ব নেন।

সামরিক অভ্যুত্থান

জিয়া ছিলেন অতি নির্মম, কিন্তু দৃঢ় চিত্তের দক্ষিণপন্থী এক সেনাপতি। জিয়াকে একান্ত অনুগত ভেবে তাঁকে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দিলেও তাঁর মানসিক গঠন সম্পর্কে ভুট্টো খুব অল্পই জানতেন। ফলে ভুট্টোকে একের পর এক ধোঁকা দিতে পেরেছেন তিনি। তাই নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক সংকটের শেষ মুহূর্তেও জিয়াকে অরাজনৈতিক ভেবে যাচ্ছিলেন ভুট্টো।

১৯৭৭ সালের ৭ মার্চের সাধারণ নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) জয়লাভ করে। তবে নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ তোলেন ভুট্টোবিরোধীরা। তাঁরা ভুট্টোর নতুন সরকারকে অবৈধ ঘোষণা করেন। তাঁর পদত্যাগ দাবি করে পুনর্নির্বাচন চান। এই দাবিতে বিরোধীদের আন্দোলন সহিংস রূপ নেয়। বিরোধীরা প্রকাশ্যে সামরিক হস্তক্ষেপ চায়। ভুট্টো অবশ্য একপর্যায়ে ছাড় দিতে রাজি হন। নতুন নির্বাচন নিয়ে বিরোধীদের সঙ্গে তাঁর একটা বোঝাপড়াও হয়।

১৯৭৭ সালের ৫ জুলাই উভয় পক্ষের মধ্যে একটা চুক্তি সইয়ের কথা ছিল। এদিনই ‘অপারেশন ফেয়ার প্লে’ নামে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ভুট্টোকে ক্ষমতাচ্যুত করেন জিয়া। তাঁর আদেশে ভুট্টো ও তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যদের গ্রেপ্তার করা হয়। অথচ অভ্যুত্থানের আগের দিনই মন্ত্রিসভার বৈঠকে জিয়াকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন ভুট্টো।

ক্ষমতা দখল করে জিয়া সামরিক আইন জারি করেন। স্থগিত করেন সংবিধান। ভেঙে দেন জাতীয় পরিষদ।

জিয়া নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত করেন। টেলিভিশনে দেওয়া ভাষণে ৯০ দিনের মধ্যে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণা দেন। তবে তাঁর এই ঘোষণা ছিল পুরোপুরি ‘আইওয়াশ’। তিনি আর নির্বাচন দেননি।

পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোছবি: পাকিস্তান সরকারের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া

ভুট্টোকে ফাঁসিতে ঝোলান জিয়া

ক্ষমতা নির্বিঘ্ন করতে পথের কাঁটা ভুট্টোকে চিরতরে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা নেন জিয়া। এ জন্য তিনি ১৯৭৪ সালের একটি হত্যাকাণ্ডকে অস্ত্র হিসেবে বেছে নেন।

লাহোরের রাজনীতিবিদ আহমেদ রাজা কাসুরি পিপিপি করলেও নানা বিষয়ে ভুট্টোর সঙ্গে তাঁর মতবিরোধ দেখা দিয়েছিল। ১৯৭৪ সালে তাঁর গাড়িতে হামলা হয়। তিনি বাঁচলেও তাঁর বাবা নওয়াব মোহাম্মদ আহমেদ খান কাসুরি নিহত হন। এই ঘটনায় রাজা কাসুরি এফআইআর করেন। তিনি এই হামলায় ভুট্টোর হাত থাকার অভিযোগ তোলেন। ১৯৭৫ সালের অক্টোবরে মামলাটি বাতিল হয়। পুরোনো এফআইআরটি ১৯৭৭ সালে পুনরুজ্জীবিত করেন জিয়া।

১৯৭৭ সালের অক্টোবরে সরাসরি লাহোর হাইকোর্টে ভুট্টোর বিরুদ্ধে হত্যা মামলার বিচার শুরু হয়। ১৯৭৮ সালের ১৮ মার্চ লাহোর হাইকোর্ট ভুট্টোকে মৃত্যুদণ্ড দেন।

জেনারেল জিয়া ১৯৭৮ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর নিজেকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেন। পিপিপি-প্রধানকে ছেড়ে দিতে জিয়ার কাছে অনেকে অনুরোধ করেন। তবে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯৭৯ সালের ২৪ মার্চ পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ভুট্টোর মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রাখেন। রিভিউ আবেদনেও একই রায় বহাল থাকে। ভুট্টোর পক্ষে বড় বোন প্রেসিডেন্ট জিয়ার কাছে ক্ষমার আবেদন করেন। আবেদন নাকচ করেন জিয়া। ১৯৭৯ সালের ৪ এপ্রিল দিবাগত রাত দুইটায় রাওয়ালপিন্ডি জেলা কারাগারে ফাঁসির মাধ্যমে ভুট্টোর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। ভুট্টোর সমর্থকেরা এই ফাঁসিকে বিচারিক হত্যাকাণ্ড বলে অভিহিত করেন।

ভুট্টোর ফাঁসি কার্যকর করার পর পাকিস্তান শাসনে জিয়ার সামনে আর কোনো বাধা থাকে না। তিনি ১১ বছর দেশ শাসন করেন।

দমনমূলক শাসন

পাকিস্তানে একটি দমনমূলক শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জিয়া। তিনি তাঁর বিরোধীপক্ষ, গণতন্ত্রপন্থীসহ দেশটির উদার রাজনৈতিক কর্মী-গোষ্ঠীর ওপর ব্যাপক দমন–পীড়ন চালান। তাঁর শাসনামলে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘনের অজস্র ঘটনা ঘটে। তিনি মতপ্রকাশ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতাসহ জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ করেন।

সামরিক শাসক হিসেবে জিয়ার প্রথম নির্দেশই ছিল পাকিস্তানে রাজনৈতিক কার্যক্রম বন্ধের। তিনি সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করেছিলেন। ট্রেড ইউনিয়নের তৎপরতাও বন্ধ করেন তিনি।

পাকিস্তানের রাজনৈতিক কাঠামোকে বদলে দেন জিয়া। তাঁর সামরিক সরকারের মূল নীতি ছিল পাকিস্তানকে একটা ধর্মরাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। জিয়া তাঁর স্বৈরতান্ত্রিক ও অগণতান্ত্রিক সব পদ্ধতিকে যুক্তিগ্রাহ্য করতে ইসলামকে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেন। সংবিধান, আইন, বিচার, আমলাতন্ত্র, শিক্ষাসহ সমাজের সব স্তরকে ইসলামীকরণের জোর উদ্যোগ নেন তিনি।

পাকিস্তানে কট্টর ইসলামি মতাদর্শের বিকাশ ও বিস্তারে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন জিয়া। গত শতকের আশির দশকে আফগান যুদ্ধে সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়তে তিনি ইসলামপন্থী উগ্রবাদী গোষ্ঠী তৈরি করেছিলেন। এ ছাড়া জিয়া সরকারের অগ্রাধিকারে ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের সামরিকীকরণ।

পাকিস্তানের সাবেক সেনাশাসক মুহাম্মদ জিয়া-উল-হকছবি: পাকিস্তান সরকারের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া

উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত

১৯৮৮ সালের ১৭ আগস্ট জিয়া পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের বাহাওয়ালপুর থেকে সামরিক বাহিনীর সি-১৩০বি হারকিউলিস উড়োজাহাজে করে ইসলামাবাদ যাচ্ছিলেন।

উড়োজাহাজটি ঠিকঠাকভাবেই উড্ডয়ন করে। কিন্তু উড্ডয়নের অল্প সময়ের মধ্যেই উড়োজাহাজটির সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ টাওয়ারের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, মাঝ আকাশে উড়োজাহাজটি ওপর-নিচ করছিল। একপর্যায়ে উড়োজাহাজটি খাড়াভাবে নিচের দিকে নামতে থাকে। এরপর মাঝ আকাশেই বিস্ফোরণ ঘটে। প্রেসিডেন্ট জিয়াসহ ৩২ জন নিহত হন। নিহতের এ তালিকায় জিয়ার ঘনিষ্ঠ সহযোগী তখনকার সর্বোচ্চ সামরিক কর্মকর্তা জেনারেল আখতার আব্দুর রহমান ছিলেন। ছিলেন পাকিস্তানে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত আরনল্ড লুইস রাফেল।

উড়োজাহাজ বিধ্বস্তের ঘটনা নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি এই উপসংহার টানে যে উড়োজাহাজ বিধ্বস্তের সবচেয়ে সম্ভাব্য কারণ নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড। উড়োজাহাজের ভেতরে বিষাক্ত গ্যাস ছড়ানো হয়েছিল, যা আরোহীদের নিস্তেজ করে দিয়েছিল। ফলে উড়োজাহাজ থেকে কোনো জরুরি সংকেত আসেনি। উড়োজাহাজটির ব্ল্যাক বক্সও পাওয়া যায়নি।

রহস্যজনক এই উড়োজাহাজ বিধ্বস্তের ঘটনা নিয়ে নানা ষড়যন্ত্র–তত্ত্ব আছে। ২০২০ সালে জিয়ার ছেলে মুহাম্মদ ইজাজুল হক এক সাক্ষাৎকারে দাবি করেন, তিনি যেসব তথ্য–প্রমাণ জোগাড় করেছেন, তা বলছে, উড়োজাহাজে নার্ভ গ্যাস (নার্ভ এজেন্ট) ছড়ানো হয়েছিল। এ কারণে পাইলটেরা নিস্তেজ হয়ে যান। এ ছাড়া উড্ডয়নের আগে উড়োজাহাজে আমভর্তি ক্যারেট তোলা হয়েছিল। এই ক্যারেটে বিস্ফোরক ছিল। পাশাপাশি বাইরের দিক থেকে কিছু একটা উড়োজাহাজটিকে আঘাত করেছিল।

এমন কথাও বলা হয়, আফগানিস্তানে সোভিয়েত বাহিনীর বিপক্ষে মুজাহিদিনদের সমর্থন দেওয়ায় জিয়াকে হত্যা করা হয়। সোভিয়েত বা তার কোনো মিত্র এবং জিয়ার সেনাবাহিনীর ভেতরের কোনো গোষ্ঠীর এই কাজে হাত ছিল। এ ছাড়া দেশ-বিদেশের নানা ব্যক্তি-গোষ্ঠীকে এই ঘটনার জন্য দায়ী করার প্রবণতা দেখা যায়।

কিন্তু এই রহস্যের কিনারা এখনো হয়নি। ফলে জিয়াকে নিয়ে উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনাটি নিয়ে চর্চা অব্যাহত আছে। ষড়যন্ত্র–তত্ত্বের ডালপালা এখনো ছড়াচ্ছে। তবে এই বিষয়টির বাইরে অন্য কারণেও জিয়াকে নিয়ে এখনো পাকিস্তানে আলোচনা হয়। উদারপন্থী বিশ্লেষকেরা বলে থাকেন, ইসলামি চরমপন্থার বিকাশ-বিস্তারসহ নানাভাবে পাকিস্তান রাষ্ট্রের যে সর্বনাশ জিয়া করে গেছেন, তার মাশুল দিয়ে যাচ্ছে দেশটি।

তথ্যসূত্র

আলতাফ পারভেজ (২০২৩), জুলফিকার আলী ভুট্টো: দক্ষিণ এশিয়ার কুলীন রাজনীতির এক অধ্যায়, বাতিঘর। এবং দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, ডন, ডয়চে ভেলে ও আনাদালু এজেন্সি।

ট্যাগ :

শেয়ার করুন

পাকিস্তানের সেনাশাসক জিয়ার সেই উড়োজাহাজে কী কারণে বিস্ফোরণ হয়েছিল

সময় : ০৭:৪২:৩৮ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২০ অগাস্ট ২০২৪

পাকিস্তানের সাবেক সেনাশাসক মুহাম্মদ জিয়া-উল-হকছবি: পাকিস্তানভিত্তিক ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া

মুহাম্মদ জিয়া-উল-হককে বিশ্বাস করে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো। সেনাপ্রধান হওয়ার এক বছরের মাথায় জেনারেল জিয়া তাঁর নিয়োগকর্তা ভুট্টোকে ক্ষমতাচ্যুত করেন।

রক্তপাতহীন সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে বিতর্কিত বিচারের মাধ্যমে ভুট্টোকে ফাঁসিতে ঝোলান জিয়া। অবশ্য জিয়ার স্বৈরশাসনেরও অবসান ঘটে ট্র্যাজেডির মধ্য দিয়ে। সামরিক উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে নিহত হন তিনি। উড়োজাহাজ বিধ্বস্তের ঘটনাটি রহস্যঘেরা।

সামরিক জীবন

জিয়ার জন্ম ১৯২৪ সালের ১২ আগস্ট। ব্রিটিশ ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের জলন্ধরের একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে। এলাকাটি এখন ভারতের অন্তর্ভুক্ত।

বাবা মুহাম্মদ আকবর আলী। তিনি অবিভক্ত ভারতের দিল্লিতে আর্মি জেনারেল হেডকোয়ার্টার্সে কাজ করেছেন।

জিয়ার স্কুল-কলেজের শিক্ষা সিমলায়। তিনি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট স্টিফেন’স কলেজ থেকে ১৯৪৩ সালে বিএ পাস করেন। এরপর তিনি দেরাদুনের রয়্যাল ইন্ডিয়ান মিলিটারি একাডেমিতে যোগ দেন। ১৯৪৫ সালে তিনি ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মিতে কমিশন লাভ করেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেন জিয়া। তিনি ১৯৪৫ সালে বার্মা, মালায় ও ইন্দোনেশিয়ায় দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর জিয়ার পরিবার পাকিস্তানে চলে যায়। তিনি ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন।

১৯৬২ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে সামরিক প্রশিক্ষণ নেন জিয়া। ১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের সময় তিনি ১০১ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডের অ্যাসিস্ট্যান্ট কোয়ার্টার মাস্টার ছিলেন।

ব্রিগেডিয়ার পদে থাকাকালে জিয়া ১৯৬৭ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত জর্ডানে পাকিস্তানের সামরিক প্রশিক্ষণ মিশনের প্রধান হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় তিনি ডেপুটি ডিভিশন কমান্ডার ছিলেন। ১৯৭৫ সালে জিয়া লেফটেন্যান্ট জেনারেল হন।

উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে জিয়া-উল-হক নিহত হওয়ার ঘটনা নিয়ে সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরছবি: ডন পত্রিকার স্ক্রিনশট

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চরিত্র জানতেন প্রধানমন্ত্রী ভুট্টো। তাই তিনি সব সময় সামরিক অভ্যুত্থানের আশঙ্কায় থাকতেন। এই আশঙ্কা থেকে তিনি নানা পদক্ষেপ নিচ্ছিলেন। সেনাবাহিনীর সম্ভাব্য হুমকির বিরুদ্ধে প্রাতিষ্ঠানিক রক্ষাকবচ হিসেবে তিনি এফএসএফ নামের একটি আধা সামরিক বাহিনী গঠন করেছিলেন। এফএসএফ হয়ে ওঠে ভুট্টোর ব্যক্তিগত বাহিনী। এই বাহিনীর সদস্যসংখ্যা ১৯৭৬ সাল নাগাদ ১৮ হাজারে পৌঁছে যায়। এই প্রেক্ষাপটে এফএসএফকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতে শুরু করে মূল সশস্ত্র বাহিনী। এ নিয়ে ভুট্টোর প্রতি সশস্ত্র বাহিনীর সন্দেহ-অবিশ্বাস বেড়ে যায়।

১৯৭৬ সালে সেনাপ্রধান টিক্কা খানের উত্তরসূরি নির্বাচনের সময় অনেক হিসাব-নিকাশ করে জিয়াকেই বেছে নেন ভুট্টো। সাতজন জ্যেষ্ঠ লেফটেন্যান্ট জেনারেলকে ডিঙিয়ে জিয়াকে সেনাপ্রধান করা হয়। তাঁকে সেনাপ্রধান না করতে পরামর্শ দিয়েছিলেন টিক্কা খান। তাঁর সুপারিশ ছিল লেফটেন্যান্ট জেনারেল মুহাম্মদ আকবর খানের জন্য। জ্যেষ্ঠতার ক্রমে তিনি তৃতীয় স্থানে ছিলেন। কিন্তু জিয়াকেই নিজের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ ভেবেছিলেন ভুট্টো। চার তারকার জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে জিয়াকে চিফ অব আর্মি স্টাফ হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। ১৯৭৬ সালের ১ মার্চ তিনি পাকিস্তানের সেনাপ্রধানের দায়িত্ব নেন।

সামরিক অভ্যুত্থান

জিয়া ছিলেন অতি নির্মম, কিন্তু দৃঢ় চিত্তের দক্ষিণপন্থী এক সেনাপতি। জিয়াকে একান্ত অনুগত ভেবে তাঁকে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দিলেও তাঁর মানসিক গঠন সম্পর্কে ভুট্টো খুব অল্পই জানতেন। ফলে ভুট্টোকে একের পর এক ধোঁকা দিতে পেরেছেন তিনি। তাই নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক সংকটের শেষ মুহূর্তেও জিয়াকে অরাজনৈতিক ভেবে যাচ্ছিলেন ভুট্টো।

১৯৭৭ সালের ৭ মার্চের সাধারণ নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) জয়লাভ করে। তবে নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ তোলেন ভুট্টোবিরোধীরা। তাঁরা ভুট্টোর নতুন সরকারকে অবৈধ ঘোষণা করেন। তাঁর পদত্যাগ দাবি করে পুনর্নির্বাচন চান। এই দাবিতে বিরোধীদের আন্দোলন সহিংস রূপ নেয়। বিরোধীরা প্রকাশ্যে সামরিক হস্তক্ষেপ চায়। ভুট্টো অবশ্য একপর্যায়ে ছাড় দিতে রাজি হন। নতুন নির্বাচন নিয়ে বিরোধীদের সঙ্গে তাঁর একটা বোঝাপড়াও হয়।

১৯৭৭ সালের ৫ জুলাই উভয় পক্ষের মধ্যে একটা চুক্তি সইয়ের কথা ছিল। এদিনই ‘অপারেশন ফেয়ার প্লে’ নামে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ভুট্টোকে ক্ষমতাচ্যুত করেন জিয়া। তাঁর আদেশে ভুট্টো ও তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যদের গ্রেপ্তার করা হয়। অথচ অভ্যুত্থানের আগের দিনই মন্ত্রিসভার বৈঠকে জিয়াকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন ভুট্টো।

ক্ষমতা দখল করে জিয়া সামরিক আইন জারি করেন। স্থগিত করেন সংবিধান। ভেঙে দেন জাতীয় পরিষদ।

জিয়া নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত করেন। টেলিভিশনে দেওয়া ভাষণে ৯০ দিনের মধ্যে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণা দেন। তবে তাঁর এই ঘোষণা ছিল পুরোপুরি ‘আইওয়াশ’। তিনি আর নির্বাচন দেননি।

পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোছবি: পাকিস্তান সরকারের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া

ভুট্টোকে ফাঁসিতে ঝোলান জিয়া

ক্ষমতা নির্বিঘ্ন করতে পথের কাঁটা ভুট্টোকে চিরতরে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা নেন জিয়া। এ জন্য তিনি ১৯৭৪ সালের একটি হত্যাকাণ্ডকে অস্ত্র হিসেবে বেছে নেন।

লাহোরের রাজনীতিবিদ আহমেদ রাজা কাসুরি পিপিপি করলেও নানা বিষয়ে ভুট্টোর সঙ্গে তাঁর মতবিরোধ দেখা দিয়েছিল। ১৯৭৪ সালে তাঁর গাড়িতে হামলা হয়। তিনি বাঁচলেও তাঁর বাবা নওয়াব মোহাম্মদ আহমেদ খান কাসুরি নিহত হন। এই ঘটনায় রাজা কাসুরি এফআইআর করেন। তিনি এই হামলায় ভুট্টোর হাত থাকার অভিযোগ তোলেন। ১৯৭৫ সালের অক্টোবরে মামলাটি বাতিল হয়। পুরোনো এফআইআরটি ১৯৭৭ সালে পুনরুজ্জীবিত করেন জিয়া।

১৯৭৭ সালের অক্টোবরে সরাসরি লাহোর হাইকোর্টে ভুট্টোর বিরুদ্ধে হত্যা মামলার বিচার শুরু হয়। ১৯৭৮ সালের ১৮ মার্চ লাহোর হাইকোর্ট ভুট্টোকে মৃত্যুদণ্ড দেন।

জেনারেল জিয়া ১৯৭৮ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর নিজেকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেন। পিপিপি-প্রধানকে ছেড়ে দিতে জিয়ার কাছে অনেকে অনুরোধ করেন। তবে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯৭৯ সালের ২৪ মার্চ পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ভুট্টোর মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রাখেন। রিভিউ আবেদনেও একই রায় বহাল থাকে। ভুট্টোর পক্ষে বড় বোন প্রেসিডেন্ট জিয়ার কাছে ক্ষমার আবেদন করেন। আবেদন নাকচ করেন জিয়া। ১৯৭৯ সালের ৪ এপ্রিল দিবাগত রাত দুইটায় রাওয়ালপিন্ডি জেলা কারাগারে ফাঁসির মাধ্যমে ভুট্টোর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। ভুট্টোর সমর্থকেরা এই ফাঁসিকে বিচারিক হত্যাকাণ্ড বলে অভিহিত করেন।

ভুট্টোর ফাঁসি কার্যকর করার পর পাকিস্তান শাসনে জিয়ার সামনে আর কোনো বাধা থাকে না। তিনি ১১ বছর দেশ শাসন করেন।

দমনমূলক শাসন

পাকিস্তানে একটি দমনমূলক শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জিয়া। তিনি তাঁর বিরোধীপক্ষ, গণতন্ত্রপন্থীসহ দেশটির উদার রাজনৈতিক কর্মী-গোষ্ঠীর ওপর ব্যাপক দমন–পীড়ন চালান। তাঁর শাসনামলে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘনের অজস্র ঘটনা ঘটে। তিনি মতপ্রকাশ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতাসহ জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ করেন।

সামরিক শাসক হিসেবে জিয়ার প্রথম নির্দেশই ছিল পাকিস্তানে রাজনৈতিক কার্যক্রম বন্ধের। তিনি সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করেছিলেন। ট্রেড ইউনিয়নের তৎপরতাও বন্ধ করেন তিনি।

পাকিস্তানের রাজনৈতিক কাঠামোকে বদলে দেন জিয়া। তাঁর সামরিক সরকারের মূল নীতি ছিল পাকিস্তানকে একটা ধর্মরাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। জিয়া তাঁর স্বৈরতান্ত্রিক ও অগণতান্ত্রিক সব পদ্ধতিকে যুক্তিগ্রাহ্য করতে ইসলামকে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেন। সংবিধান, আইন, বিচার, আমলাতন্ত্র, শিক্ষাসহ সমাজের সব স্তরকে ইসলামীকরণের জোর উদ্যোগ নেন তিনি।

পাকিস্তানে কট্টর ইসলামি মতাদর্শের বিকাশ ও বিস্তারে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন জিয়া। গত শতকের আশির দশকে আফগান যুদ্ধে সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়তে তিনি ইসলামপন্থী উগ্রবাদী গোষ্ঠী তৈরি করেছিলেন। এ ছাড়া জিয়া সরকারের অগ্রাধিকারে ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের সামরিকীকরণ।

পাকিস্তানের সাবেক সেনাশাসক মুহাম্মদ জিয়া-উল-হকছবি: পাকিস্তান সরকারের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া

উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত

১৯৮৮ সালের ১৭ আগস্ট জিয়া পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের বাহাওয়ালপুর থেকে সামরিক বাহিনীর সি-১৩০বি হারকিউলিস উড়োজাহাজে করে ইসলামাবাদ যাচ্ছিলেন।

উড়োজাহাজটি ঠিকঠাকভাবেই উড্ডয়ন করে। কিন্তু উড্ডয়নের অল্প সময়ের মধ্যেই উড়োজাহাজটির সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ টাওয়ারের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, মাঝ আকাশে উড়োজাহাজটি ওপর-নিচ করছিল। একপর্যায়ে উড়োজাহাজটি খাড়াভাবে নিচের দিকে নামতে থাকে। এরপর মাঝ আকাশেই বিস্ফোরণ ঘটে। প্রেসিডেন্ট জিয়াসহ ৩২ জন নিহত হন। নিহতের এ তালিকায় জিয়ার ঘনিষ্ঠ সহযোগী তখনকার সর্বোচ্চ সামরিক কর্মকর্তা জেনারেল আখতার আব্দুর রহমান ছিলেন। ছিলেন পাকিস্তানে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত আরনল্ড লুইস রাফেল।

উড়োজাহাজ বিধ্বস্তের ঘটনা নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি এই উপসংহার টানে যে উড়োজাহাজ বিধ্বস্তের সবচেয়ে সম্ভাব্য কারণ নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড। উড়োজাহাজের ভেতরে বিষাক্ত গ্যাস ছড়ানো হয়েছিল, যা আরোহীদের নিস্তেজ করে দিয়েছিল। ফলে উড়োজাহাজ থেকে কোনো জরুরি সংকেত আসেনি। উড়োজাহাজটির ব্ল্যাক বক্সও পাওয়া যায়নি।

রহস্যজনক এই উড়োজাহাজ বিধ্বস্তের ঘটনা নিয়ে নানা ষড়যন্ত্র–তত্ত্ব আছে। ২০২০ সালে জিয়ার ছেলে মুহাম্মদ ইজাজুল হক এক সাক্ষাৎকারে দাবি করেন, তিনি যেসব তথ্য–প্রমাণ জোগাড় করেছেন, তা বলছে, উড়োজাহাজে নার্ভ গ্যাস (নার্ভ এজেন্ট) ছড়ানো হয়েছিল। এ কারণে পাইলটেরা নিস্তেজ হয়ে যান। এ ছাড়া উড্ডয়নের আগে উড়োজাহাজে আমভর্তি ক্যারেট তোলা হয়েছিল। এই ক্যারেটে বিস্ফোরক ছিল। পাশাপাশি বাইরের দিক থেকে কিছু একটা উড়োজাহাজটিকে আঘাত করেছিল।

এমন কথাও বলা হয়, আফগানিস্তানে সোভিয়েত বাহিনীর বিপক্ষে মুজাহিদিনদের সমর্থন দেওয়ায় জিয়াকে হত্যা করা হয়। সোভিয়েত বা তার কোনো মিত্র এবং জিয়ার সেনাবাহিনীর ভেতরের কোনো গোষ্ঠীর এই কাজে হাত ছিল। এ ছাড়া দেশ-বিদেশের নানা ব্যক্তি-গোষ্ঠীকে এই ঘটনার জন্য দায়ী করার প্রবণতা দেখা যায়।

কিন্তু এই রহস্যের কিনারা এখনো হয়নি। ফলে জিয়াকে নিয়ে উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনাটি নিয়ে চর্চা অব্যাহত আছে। ষড়যন্ত্র–তত্ত্বের ডালপালা এখনো ছড়াচ্ছে। তবে এই বিষয়টির বাইরে অন্য কারণেও জিয়াকে নিয়ে এখনো পাকিস্তানে আলোচনা হয়। উদারপন্থী বিশ্লেষকেরা বলে থাকেন, ইসলামি চরমপন্থার বিকাশ-বিস্তারসহ নানাভাবে পাকিস্তান রাষ্ট্রের যে সর্বনাশ জিয়া করে গেছেন, তার মাশুল দিয়ে যাচ্ছে দেশটি।

তথ্যসূত্র

আলতাফ পারভেজ (২০২৩), জুলফিকার আলী ভুট্টো: দক্ষিণ এশিয়ার কুলীন রাজনীতির এক অধ্যায়, বাতিঘর। এবং দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, ডন, ডয়চে ভেলে ও আনাদালু এজেন্সি।