টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে গোড়াই শিল্পাঞ্চলে দেনার বোঝা মাথায় নিয়ে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস কর্পোরেশনের রাষ্ট্রায়ত্ত একমাত্র সুতা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান টাঙ্গাইল কটন মিলস বন্ধ রয়েছে দুই যুগ ধরে। ফলে মিলের কোটি কোটি টাকার যন্ত্রপাতি চুরি ও ভবন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
জানা যায়, এই সুযোগে মিলের আশপাশে ও ভিতরে মূল্যবান জমি বেদখল হয়ে যাচ্ছে। বিশাল এলাকা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত সুতা উৎপাদনের মিলটি বন্ধ থাকায় মিলে কর্মরত প্রায় ৩-৪ হাজার শ্রমিক কর্মচারী বেকার হয়ে বর্তমানে পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর ভাবে জীবন যাপন করছে।
এলাকাবাসী জানিয়েছেন সরকার টাঙ্গাইল কটন মিলটি (পিপিএম) পদ্ধতিতে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনার শিপের মাধ্যমে পুনরায় চালুর উদ্যোগ গ্রহণের কথা থাকলেও লাল ফিতার দৌরাত্ম্যে মিলটি চাল হচ্ছে না।
রবিবার (২৩ নভেম্বর) ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক সংলগ্ন মির্জাপুরে গোড়াই শিল্পাঞ্চলে অবস্থিত টাঙ্গাইল কটন মিলস এলাকায় খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে চার দিকে কেবলই সুনসান নীরবতা। মিলে নেই শ্রমিক কর্মচারীর কল-কাকলী। মিলটির প্রধান গেইটটি শুধুই নিস্তব্ধ স্মৃতি বহন করে দাড়িয়ে আছে।
টাঙ্গাইল কটন মিলস সূত্রে জানা গেছে, ২৬ দশমিক ২৮৫ একর বিশাল এলাকা নিয়ে ১৯৬২ সালে টাঙ্গাইল কটন মিলের এক নং ইউনিটি চালু হয়। এটিই ছিল টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার গোড়াই শিল্পাঞ্চলের রাষ্ট্রায়ত্ত একমাত্র প্রথম সুতা উৎপাদনের মিল। বাঁশি বাজার সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিক-কর্মচারীদের কলকাকলিতে মিল এলাকা মুখরিত। মিলের উৎপাদন ভাল হওয়ায় ১৯৭৮ সালে দুই নং ইউনিট চালু হয়। এই মিলে হাই কোয়ালিটির ৮০, ৬০, ৭০ ও ৪০ কাউন্টের সুতা উৎপাদন হতো। মিলের উন্নত মানের সুতা উৎপাদন হওয়ায় দেশে বিদেশে রপ্তানি করে সরকার প্রচুর বৈশ্বিক মুদ্রা আয় করে। দুই ইউনিটি মিলে এলাকার ৪ হাজার শ্রমিক কর্মচারী কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছিল। বিশাল এলাকা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত এই টাঙ্গাইল কটন মিলে উৎপাদন ভাল হওয়ায় শ্রমিক-কর্মচারীদের পাদচারণায় ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত মুখরিত ছিল। মিলটিকে ঘিরে এখানে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি মাদ্রাসা, একটি ডাকঘর, পল্লী বিদ্যুৎ সাব স্টেশনসহ বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে উঠেছিল। মিলটি বন্ধ হওয়ায় এসব প্রতিষ্ঠান এখন বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। সেই সঙ্গে এলাকায় নতুন করে বেকারের সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে।
মিলের সাবেক কর্মচারীদের মধ্যে বাবুল সিকদার ও আব্দুর রহমান সুবাদারসহ অনেকেই অভিযোগ করেন, টাঙ্গাইল কটন মিলের কিছু অসাধু ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং সিবিএ নেতাদের অব্যবস্থাপনা ও অনিয়ম দুর্নীতির কারণে ৮৫-৯০ দশকে মিলটি দেনায় পরিণত হয়। কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সিবিএ নেতাদের সিন্ডিকেটের কারণে দেনার ভারে জর্জরিত হয়ে পড়ে মিলটি। প্রথমে মিলের দুই নং ইউনিট ১৯৯৮ সালে বন্ধ হয়ে যায়। বেকার হয়ে পরে প্রায় দুই হাজার শ্রমিক কর্মচারী। এক নং ইউনিটি চালু থাকলেও লোকসানের কারণে ২০০৮ সালে এই ইউনিটিও বন্ধ হয়ে যায়।
আরো পড়ুনঃ সাবেক প্রধান বিচারপতি রুহুল আমিন মারা গেছেন
তারা আরও জানায়, মিলের দুইটি ইউনিটি পুরোপুরি বন্ধ থাকায় ৩-৪ হাজার শ্রমিক কর্মচারী কর্মহীন হয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর ভাবে জীবনযাপন করছে। বিশাল এলাকা নিয়ে গঠিত টাঙ্গাইল কটন মিলের কয়েক শত কোটি টাকার ষন্ত্রপাতি নষ্ট হচ্ছে এবং ভবনগুলোও অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। এছাড়া মিলের বেশ কিছু সম্পত্তি প্রভাবশালীদের দখলে চলে যাচ্ছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
মিলে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, মিলটি দেখভালের জন্য একজন প্রধান নির্বাহীর নেতৃত্বে দৈনিক বেতনভুক্ত ১০-১২ জন কর্মচারী কাজ করে যাচ্ছেন। মিলটি পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের মাধ্যমে পুনরায় চালু করা হলে এলাকার বহু বেকারের নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং সরকারও প্রচুর লাভবান হবে বলে মিলের সাবেক কর্মচারীরা জানিয়েছেন।
এ ব্যাপারে টাঙ্গাইল কটন মিলের প্রধান নির্বাহী (মিল ইনচার্জ) মিজানুর রহমান বলেন, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিল কর্পোরেশনের প্রথম সুতা উৎপাদন প্রতিষ্ঠান ছিল টাঙ্গাইল কটন মিল। ঐ সময়ে লোকসানের কারণে মিলটি বন্ধ থাকায় এলাকায় বেকার শ্রমিকের সংখ্যা বেড়ে গেছে। টাঙ্গাইল কটন মিলটি (পিপিএম) পদ্ধতিতে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনার শিপের মাধ্যমে পুনরায় চালুর উদ্যোগ নেওয়া হলেও এখন পর্যন্ত তা আলোর মুখ দেখেনি। সরকার পদক্ষেপ গ্রহণ করলে মিলটি পুনরায় চালু করা সম্ভব হবে। চালু না হলে শতশত কোটি টাকার যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সেইসঙ্গে বিপুল পরিমাণ সম্পত্তিও দিন দিন অবৈধ দখলদারের হাতে চলে যাচ্ছে।