মুন্সিগঞ্জের এই কলেজ মায়ায় বাঁধে শিক্ষার্থীদের
- সময় : ০৮:০০:০৬ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২০ অগাস্ট ২০২৪
- / ১০ বার দেখেছে
কী সবার আগে আপনার নজর কাড়বে?
সবুজ ঘাসে ঢাকা বিশাল মাঠ? মাঠের দক্ষিণ ও পশ্চিম পাশের ফুলের বাগান? শতবর্ষী জামগাছ? নাকি চারপাশ বাঁধানো বিশাল পুকুর? কলেজ যদি খোলা থাকে, তাহলে হয়তো এসবের কোনোটিই নয়, সবার আগে আপনার চোখে পড়বে তারুণ্যের উচ্ছ্বাস।
মুন্সিগঞ্জের হরগঙ্গা কলেজে ঢুঁ মেরেছিলাম ১০ জুলাই। ক্যাম্পাসের জামতলায় দেখা হয়ে গেল ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী নাজমুল, রাইয়ান, মাহমুদুল, ফয়সাল, মাহবুব, হামজা, সৈকত, জান্নাত, লামিয়া, মুক্তিসহ প্রায় ১৫ জনের দলটির সঙ্গে। তাঁদের আলাপেও ঘুরেফিরে আসছিল ক্যাম্পাসের সৌন্দর্যের প্রতি মুগ্ধতার কথা। এই পরিবেশই নাকি তাঁদের আটকে ফেলে এক অন্য রকম মায়ায়।
জান্নাত আর লামিয়া—দুই শিক্ষার্থী নিয়মিত নারায়ণগঞ্জ থেকে ক্যাম্পাসে আসেন। জানালেন, রাজনৈতিক ঝামেলা কম, পড়ালেখার মান ভালো, শিক্ষকেরা বন্ধুসুলভ—এসব সুনাম শুনেই হরগঙ্গা কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। তবে সব ছাপিয়ে এখন ক্যাম্পাসের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই তাঁদের টানে। জান্নাত বলছিলেন, ‘পড়াশোনা শেষে যখন কলেজ ছেড়ে চলে যাব, এই জামতলা, পুকুরপাড় খুব মিস করব।’
স্থানীয় মানুষেরা অবশ্য ক্যাম্পাসকে মিস করতে চান না। অনেক বছর আগে যাঁরা কলেজ ছেড়েছেন, তাঁরাও সুযোগ পেলে ঢুঁ মেরে যান। আমাদের যেমন ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষের আবুল কাশেম ও শাকিল আহম্মেদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। ক্যাম্পাসের আড্ডা, মাঠ, পুকুর ঘাট, জামতলা, হোস্টেলের আঁটসাঁট বিছানা—কিছুই ভুলতে পারেননি। তাই সুযোগ পেলে চলে আসেন। শাকিল আহম্মেদ বলছিলেন, ‘আমাদের সময় অবশ্য অনেক কিছু ছিল না। এখন ক্যাম্পাস আরও সুন্দর হয়েছে।’
১৯৩৮ থেকে ২০২৪
সরকারি হরগঙ্গা কলেজের জন্মের পেছনের গল্প শোনালেন হিসাববিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান, ‘১৯৩৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর ১০ দশমিক ৭২ একর জমির ওপর আমাদের কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন টঙ্গীবাড়ি উপজেলার আশুতোষ গাঙ্গুলি। তাঁর বাবা হরনাথ গাঙ্গুলি ও মা গঙ্গাশ্বরী দেবীর নামের প্রথম অংশ অনুসারে কলেজের নামকরণ হয়েছিল। সে সময় অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক হরগঙ্গা কলেজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন।’
১৯৯৫-৯৬ শিক্ষাবর্ষ থেকে কলেজে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি চালু হয়। এখন ১৭টি বিষয়ে স্নাতক ও ৯টি বিষয়ে স্নাতকোত্তর কোর্স চালু আছে। ২ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী উচ্চমাধ্যমিক ও ১০ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী আছেন স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে। শিক্ষক আছেন ৮৩ জন।
গত কয়েক বছরের তুলনায় পরীক্ষার ফলাফলের দিক দিয়ে এগিয়েছে হরগঙ্গা কলেজ। বছর পাঁচেক আগেও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় পাসের হার ছিল ৫০-৬০ শতাংশ। এখন পাসের হার ৭৫-৮০ শতাংশ। ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মুন্সি সিরাজুল হক জানান, জিপিএ–৫ এ কলেজের শিক্ষার্থীদের কাছে ছিল স্বপ্নের মতো। এখন প্রতিবছর ৫০ থেকে ৬০ জন জিপিএ–৫ পাচ্ছেন। স্নাতক ও স্নাতকোত্তরেও পাসের হার ৯০ শতাংশের বেশি।
ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সুশান্ত কুমার রায় বলেন এ কলেজের কয়েকজন কৃতী ছাত্রের কথা। ‘আমাদের প্রাক্তন ছাত্র আমিনুদ্দিন সরকার এখন যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এ কে রফিকুল ইসলামও আমাদের কলেজে পড়েছেন। সাবেক রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ ১৯৫০ সালে হরগঙ্গা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। এমন আরও অনেক গণমান্যজন আছেন।’ সাবেক রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ, লেখক ও অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, প্রাবন্ধিক অরবিন্দ পোদ্দার, নাট্যকার ও অভিনেতা মমতাজ উদ্দীন আহমেদসহ অনেকেই বিভিন্ন সময়ে এই কলেজে অধ্যাপনা করেছেন।
প্রতিবছর আমাদের কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ছাত্রছাত্রী মেডিকেল, প্রকৌশল ও অন্য স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় জায়গা করে নিচ্ছে। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের পর অনেক শিক্ষার্থী বিসিএস ক্যাডার সার্ভিসে, সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে কাজ করে কলেজের সুনাম ছড়াচ্ছে। আমরা চাই সব দিক থেকে দেশসেরা কলেজের তালিকায় আমাদের কলেজেরও নাম থাকুক। আমাদের লক্ষ্য শুধু ভালো ফলাফল নয়, ভালো মানুষ তৈরি করা। যারা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নেতৃত্ব দেবে। যদি দক্ষ, যোগ্য, ন্যায়পরায়ণ মানুষ হিসেবে শিক্ষার্থীদের গড়ে তুলতে পারি, তাহলেই বুঝব কলেজের জন্য কিছু করতে পেরেছি।
সুভাষ চন্দ্র, অধ্যক্ষ, সরকারি হরগঙ্গা কলেজ, মুন্সিগঞ্জ
নানা কার্যক্রমে সরব
সহশিক্ষা কার্যক্রমের জন্য মুন্সিগঞ্জে হরগঙ্গা কলেজের সুনাম আছে। শিক্ষার্থীদের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মধ্যে আছে রেড ক্রিসেন্ট, রোভার স্কাউট ও বিএনসিসি। ক্যাম্পাসে গানের ক্লাবটির নাম সংগীতচক্র। ওদিকে উদ্ভাবনী ভাবনা নিয়ে কাজ করে চলেছে বিজ্ঞান ক্লাব।
কলেজের শিক্ষকদের অনুপ্রেরণায় এনডেভার, ভেঞ্চার ও সবুজকুঁড়ি নামের একাধিক স্বেচ্ছাসেবী ও দাতব্য প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পরিবেশ সুরক্ষা, স্বেচ্ছায় রক্তদান প্রকল্প, দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় সহযোগিতাসহ নানা কার্যক্রম পরিচালনা করে সংগঠনগুলো।
২০২১ সালে কলেজ থেকে প্রকাশিত হয়েছে ‘রবি প্রণাম’ নামে একটি স্মারকগ্রন্থ। গবেষণামূলক এ বইয়ে শিক্ষকের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের লেখাও স্থান পেয়েছে। ইংরেজি ও আরবি বিভাগকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে দুটি ক্লাব, যা এ দুই ভাষায় শিক্ষার্থীদের দক্ষ করে তোলার পেছনে কাজ করছে।
খেলাধুলায়ও সরব থাকে হরগঙ্গা কলেজ। ২০২৩ সালে ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টনে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন কলেজের শিক্ষার্থীরা। বিতর্কেও কলেজ পর্যায়ে আছে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় হওয়ার গৌরব।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা কী বলছেন
কথা হলো ইংরেজি দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মনিরা আক্তারের সঙ্গে। বললেন, ‘উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে কলেজে খুব কড়াকড়ি ক্লাস হয়। তাই এসএসসিতে ৪ দশমিক ৭২ পয়েন্ট নিয়ে এই কলেজে ভর্তি হলেও এইচএসসিতে জিপিএ–৫ পেয়েছিলাম।’
আরেক শিক্ষার্থী ইসরাত জাহান বলেন, ‘ক্লাসে শিক্ষকেরা খুব যত্ন করে পড়ান। প্রতিটি বিভাগে ইনকোর্স পরীক্ষা চালু আছে। তাই আমাদের ফল ভালো হচ্ছে।’
হরগঙ্গা কলেজ থেকে পাস করে এখানে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছেন অনেকে। গণিত বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. সানাউল্লাহ, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জাকিয়া লায়লা, ভূগোল বিভাগের প্রভাষক জাহাঙ্গীর আলম, ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক সোনিয়া আক্তার, এস এম ফয়সাল আরাফাত—সবাই এ কলেজেরই শিক্ষার্থী ছিলেন।
উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জাকিয়া লায়লা বলেন, ‘পরিবারের সবাই সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন। সবাই তাঁদের খুব সম্মান করত। তাঁদের পরিচয়ে আমাকে চিনত। আমি চেয়েছিলাম মানুষ আমাকে আমার পরিচয়ে চিনুক। তাই শিক্ষাজীবন থেকেই সরকারি কর্মকর্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম। এ কলেজে শিক্ষার্থী হওয়ার পর শিক্ষকদের আন্তরিকতা দেখে শিক্ষক হব বলে স্থির করি। আমিও চেয়েছিলাম, আমার শিক্ষকদের মতো মুন্সিগঞ্জের ছেলেমেয়েদের জন্য কিছু করব। তাই বিসিএসে প্রথম পছন্দ দিই শিক্ষা। বিসিএস হওয়ার পর এ কলেজে চলে আসি।’