১২:৩৫ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

যোগাযোগবিচ্ছিন্ন দম বন্ধ হওয়া পাঁচ দিনের প্রবাসজীবন

রিপোর্টার
  • সময় : ০৮:৫৩:৪১ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২০ অগাস্ট ২০২৪
  • / ৫ বার দেখেছে

গত দশ বছর পড়াশনা ও চাকরির সুবাদে দেশের বাইরে অবস্থান করছি। জাপান ঘুরে আমেরিকায়। বলতে গেলে প্রবাসের রংটা একই থাকে। দিন শুরু হলে কাজ, সন্ধ্যায় বাসায় ফেরা। আর এর মধ্যে চোখ লেগে থাকে বাংলাদেশে। কোথায় কী হচ্ছে, তাৎক্ষণিক খবর নিমেষেই অনলাইন সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে জানছি। মাতৃভূমি কেমন আছে, তা নিয়ে ভাবছি, লিখছি।

২০১৬ সালে হলি আর্টিজানের ঘটনার পর সম্ভবত সবচেয়ে উৎকণ্ঠাময় সময় পার করলাম আমরা। গত সপ্তাহের ছাত্র বিক্ষোভের ঘটনায় ইন্টারনেট দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া প্রিয় মাতৃভূমিকে ঠিক কতটা ভালোবাসি, তা ক্ষণে ক্ষণে আবার টের পেয়েছি।

গত বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই ২০২৪) যখন সকালে অফিসে গিয়েছি, তখন বাংলাদেশে রাত আটটা। ল্যাবে গিয়ে কিছুতেই মন বসাতে পারছিলাম না। মৃত্যু উপত্যকায় দাঁড়িয়ে আমার প্রিয় মাতৃভূমি।

সারা দিন একের পর এক প্রাণক্ষয়ের ছবি আর ভিডিও দেখার পর চোখ প্রতিনিয়ত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও দেশের গণমাধ্যমের অনলাইনগুলোর ওপরই ছিল (বিশেষ করে প্রথম আলোয়)। কিন্তু হঠাৎ রাত নয়টার পর (যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসিফিক সময় সকাল আটটা) পর দেশের গণমাধ্যমগুলো থেকে আপডেট দেওয়া বন্ধ হয়ে গেল।

প্রথম আলোর অনলাইন পেজে মৃত্যুর সংখ্যা ১৯, আগুনে বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) বন্ধ, এমন আপডেটের পর পত্রিকাটির অনলাইন সাইট যতবারই রিফ্রেশ দিই, কোনো আপডেট পাইনি। তাৎক্ষণিক দেশের অন্যান্য গণমাধ্যমের পেজগুলোয় ঢুঁ মারতে দেখা গেল, কানেকশন টাইমড আউট।

ইন্টারেনেটের গতি বা ট্রাফিক পর্যবেক্ষণ সাইট ক্লাউডফ্লায়ার ডটকমের তথ্যে জানলাম, দেশে বৃহস্পতিবার রাত পৌনে নয়টার পর থেকে বিশ্বের একমাত্র দেশ হিসেবে বাংলাদেশ তখন ইন্টারেনেটের বাইরে।

এমন এক ভুতুড়ে অভিজ্ঞতায় আমাদের মতো লাখো প্রবাসী বাংলাদেশি দেশের খবর জানার জন্য হন্য হয়ে গেলাম। একে অপরকে জিজ্ঞাসা করলাম, কেউ কোনো তথ্য পাচ্ছেন কি না। ইউটিউবের আপডেটগুলোও পুরোনো। ফলে বাংলাদেশে সেই মুহূর্তে কী ঘটছিল, তা জানার কোনো উপায় ছিল না।

দেশের সব কটি গণমাধ্যম বাইরের দুনিয়ায় ‘ব্লাকআউট’ থাকার কারণে আমার মতো প্রবাসীদের কাছে সময়টা যে অনেকটা কালরাত্রির শামিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। দেশটাকে আমরা কতটা ভালোবাসি, তা মনে করিয়ে দিচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হাজারো প্রবাসীর দেওয়া স্ট্যাটাসগুলো।

ইন্টারনেটের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় শুধু দেশের খবর থেকেই বঞ্চিত হইনি, প্রিয়জন ও পরিবারের সঙ্গেও যোগাযোগ করতে পারিনি আমরা। এমনকি আন্তর্জাতিক ফোনকলও এ সময় অনেকটা অচল ছিল। ফলে একেকটা দিন আমাদের কাছে হয়ে উঠেছিল ভয়ার্ত একেকটি রাত।

কোটা সংস্কারের দাবিতে বৃহস্পতিবার দিনের বেলায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সাংঘর্ষিক রূপ নেওয়ার পর যে রক্তপাত, বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীদের আর্তনাদ, পুলিশের মারমুখী অবস্থান, বিভিন্ন স্থাপনায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের প্রেক্ষাপটে আমাদের প্রবাসীদের মনে কেবলই শঙ্কা বেড়ে চলে। মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে, এমন শঙ্কাও ছিল।

বিশ্বের সঙ্গে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে আমার মতো হাজারো প্রবাসীর মনে বাংলাদেশকে ব্ল্যাকআউট করে রাখার যে কৌশল ক্ষমতাসীন সরকার নিয়েছিল, তা শুধু নিন্দনীয়ই নয়, মানবাধিকার লঙ্ঘনও। যদিও সরকার বলছে যে ডেটা সেন্টারে আন্দোলনকারীদের হামলার কারণে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়, কিন্তু পরিস্থিতি বিবেচনায় বিষয়টার সত্যতা কারও কাছে আসলে অস্পষ্ট নয়।

এই পাঁচ দিনের মতো দম বন্ধ হয়ে ওঠা সময় আর যেন আমাদের জীবনে না আসে। মনে রাখতে হবে যে দেশটার নতুন প্রজন্ম একধরনের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ, বারুদ। ওরা দেশটার ইতিবাচক পরিবর্তন চায়, যে পরিবর্তন আপনি–আমিও চাই। ওদের উপেক্ষা করে লাশের ওপর দাঁড়িয়ে আপনি সুখবার্তা দিতে পারেন না, পারবেন না।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেসব মানুষের কাছ থেকে দেশ নিয়ে কোনো কথাবার্তা তেমন একটা পাই না, সেই সব প্রবাসীও দেশ নিয়ে ভাবছেন, লিখছেন, ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। হ্যাশট্যাগে ইলন মাস্কের স্টারলিংককে টানছেন, যাতে করে দেশে স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সংযোগ স্থাপিত হয়। কোথাও শেয়ার হচ্ছে গণভবন দখলের কথা, কোথাও বলা হচ্ছে যে প্রধানমন্ত্রী পালিয়ে গেছেন, কোথাও বলা হচ্ছে দেশের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে সেনাবাহিনী। কোনটা সত্য, কোনটা মিথ্যা, কিছুই বোঝার সুযোগ ছিল না।

ঠিক এমন এক সময়ে আমরা খবর পেলাম যে ঢাকা থেকে বিবিসি বাংলা সরাসরি আপডেট দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো ভারতের ব্যুরোদের দিয়ে খবর পরিবেশন করছে। যুদ্ধ–যুদ্ধ আবহের এই সব খবর হঠাৎ আমাদের একাত্তরের রেডিও বার্তাগুলোর কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। যখন মানুষের কাছে ইন্টারনেট ছিল না, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ছিল না, কিন্তু তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজেদের এককাতারে আনতে রেডিও খবরকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন।

আজ এই সংকটময় সময়ে আমরাও তেমন বিবিসি বাংলার দেওয়া খবরের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। তাতে দেশে কী ঘটছে, তা নিয়ে একটি ধারণা পাওয়া গেলেও প্রিয়জনদের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যর্থ চেষ্টা আমাদের মনে খারাপ লাগা তৈরি করছিল, যা কখনো ভোলার নয়।

অনেকের নিকটাত্মীয় মারা গেছেন, তাঁর কোনো খবর নেওয়া সম্ভব হয়নি। কেউ কেউ সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর খবর জানতে পারেননি। বিদেশের মাটিতে প্লেন থেকে নেমে পরিবারকে জানাতে সক্ষম হননি। এমন এক পরিস্থিতিতে গত পাঁচ দিন ছিলেন প্রবাসীরা।

ফেসবুকের বন্ধুদের একটি বড় অংশ বাংলাদেশের হওয়ায় তাঁদের কোনো আপডেট বা স্ট্যাটাস না পাওয়ায় ফেসবুকটাও অসাড় হতে লাগল। সরকারকে দীর্ঘদিন ধরে সমর্থন দেওয়া অনেক মানুষকে দেখলাম, সরকারের কার্যক্রমকেই তুলাধোনা করছেন। এই ক্ষোভ দেখার পর মনে হচ্ছিল, দেশটার বাইরে থাকা প্রবাসীরা কতই না ক্ষোভ পুষে রেখেছিলেন, যা সময়ের পরিক্রমায় উগরে দিচ্ছেন। এসব দেখার সুযোগ অন্তত গত পাঁচ দিনে হয়েছে।

কোটা সংস্কারের দাবিতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মনোভাব বুঝতে ব্যর্থ হওয়া সরকারপক্ষ আজকের এই রক্তপাতের জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দায়ী থাকবে। ইতিহাস আমাদের রাষ্ট্রের এই ব্যর্থতার দায় নেবে না। অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার জন্য সরকার কখনোই আন্দোলকারীদের কাঁধে দায় দিতে পারবে না। সরকার চাইলেই শুরুতেই শিক্ষার্থীদের দাবির বিষয়টি যৌক্তিকভাবে সুরাহা করতে পারত। সময় নিয়ে হলেও অন্তত শিক্ষার্থীদের আশ্বস্ত করতে পারত। তা করতে পারলে হয়তো আমাদের এত লাশের মিছিল দেখতে হতো না। সাধারণ শিক্ষার্থীদের হাত ঘুরে আন্দোলন পাড়া-মহল্লা পর্যন্ত চলে যেত না।

মাতৃভূমিকে কতটা ভালোবাসা যায়, তা আমার মতো প্রবাসে যাঁরা বসবাস করেন, তাঁরা ভালো করে জানেন। দেশের সামান্য ব্যথায় যে আমার ব্যথিত হই, তা বোঝানো কঠিন। স্মরণকালের ভয়াবহ সংকটে পড়া প্রিয় মাতৃভূমি ঠিক কতটা ক্ষত সেরে উঠবে তা জানি না, তবে আধুনিক এই প্রযুক্তির জমানায় নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখতেও পারবে না।

জেন জি জেনারেশনের এই আন্দোলন যে কেবলই একটি আন্দোলন নয়, বরং দীর্ঘদিন ধরে চলা বৈষম্য ও অনাচারের বিরুদ্ধে বড় ধরনের প্রতিবাদ যাতে ‘সাধারণ মানুষ’ ক্রমেই জড়িয়ে পড়ছিল, তা এই আন্দোলনের মধ্যে স্পষ্ট হয়েছে। যদিও কোটা সংস্কারে আদালতের ৯৩ শতাংশ মেধার পক্ষে রায় এসেছে, মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের জন্য ৫ শতাংশ রাখা হয়েছে। কিন্তু এর আগেই পরিস্থিতি এমন জায়গা চলে গেল, তা তো আমরা জানলাম।

এই পাঁচ দিনের মতো দম বন্ধ হয়ে ওঠা সময় আর যেন আমাদের জীবনে না আসে। মনে রাখতে হবে যে দেশটার নতুন প্রজন্ম একধরনের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ, বারুদ। ওরা দেশটার ইতিবাচক পরিবর্তন চায়, যে পরিবর্তন আপনি–আমিও চাই। ওদের উপেক্ষা করে লাশের ওপর দাঁড়িয়ে আপনি সুখবার্তা দিতে পারেন না, পারবেন না। এই সব হত্যাকাণ্ডের বিচার যেমন চাইছি, তেমনি এখানে যে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে রাষ্ট্রের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি করা হয়েছে, সেটি যদি কোনো পক্ষ তাদের রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টার জন্য করে থাকে, তাদের মস্তিষ্কের সুস্থতাও কামনা করছি।

ট্যাগ :

শেয়ার করুন

যোগাযোগবিচ্ছিন্ন দম বন্ধ হওয়া পাঁচ দিনের প্রবাসজীবন

সময় : ০৮:৫৩:৪১ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২০ অগাস্ট ২০২৪

গত দশ বছর পড়াশনা ও চাকরির সুবাদে দেশের বাইরে অবস্থান করছি। জাপান ঘুরে আমেরিকায়। বলতে গেলে প্রবাসের রংটা একই থাকে। দিন শুরু হলে কাজ, সন্ধ্যায় বাসায় ফেরা। আর এর মধ্যে চোখ লেগে থাকে বাংলাদেশে। কোথায় কী হচ্ছে, তাৎক্ষণিক খবর নিমেষেই অনলাইন সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে জানছি। মাতৃভূমি কেমন আছে, তা নিয়ে ভাবছি, লিখছি।

২০১৬ সালে হলি আর্টিজানের ঘটনার পর সম্ভবত সবচেয়ে উৎকণ্ঠাময় সময় পার করলাম আমরা। গত সপ্তাহের ছাত্র বিক্ষোভের ঘটনায় ইন্টারনেট দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া প্রিয় মাতৃভূমিকে ঠিক কতটা ভালোবাসি, তা ক্ষণে ক্ষণে আবার টের পেয়েছি।

গত বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই ২০২৪) যখন সকালে অফিসে গিয়েছি, তখন বাংলাদেশে রাত আটটা। ল্যাবে গিয়ে কিছুতেই মন বসাতে পারছিলাম না। মৃত্যু উপত্যকায় দাঁড়িয়ে আমার প্রিয় মাতৃভূমি।

সারা দিন একের পর এক প্রাণক্ষয়ের ছবি আর ভিডিও দেখার পর চোখ প্রতিনিয়ত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও দেশের গণমাধ্যমের অনলাইনগুলোর ওপরই ছিল (বিশেষ করে প্রথম আলোয়)। কিন্তু হঠাৎ রাত নয়টার পর (যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসিফিক সময় সকাল আটটা) পর দেশের গণমাধ্যমগুলো থেকে আপডেট দেওয়া বন্ধ হয়ে গেল।

প্রথম আলোর অনলাইন পেজে মৃত্যুর সংখ্যা ১৯, আগুনে বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) বন্ধ, এমন আপডেটের পর পত্রিকাটির অনলাইন সাইট যতবারই রিফ্রেশ দিই, কোনো আপডেট পাইনি। তাৎক্ষণিক দেশের অন্যান্য গণমাধ্যমের পেজগুলোয় ঢুঁ মারতে দেখা গেল, কানেকশন টাইমড আউট।

ইন্টারেনেটের গতি বা ট্রাফিক পর্যবেক্ষণ সাইট ক্লাউডফ্লায়ার ডটকমের তথ্যে জানলাম, দেশে বৃহস্পতিবার রাত পৌনে নয়টার পর থেকে বিশ্বের একমাত্র দেশ হিসেবে বাংলাদেশ তখন ইন্টারেনেটের বাইরে।

এমন এক ভুতুড়ে অভিজ্ঞতায় আমাদের মতো লাখো প্রবাসী বাংলাদেশি দেশের খবর জানার জন্য হন্য হয়ে গেলাম। একে অপরকে জিজ্ঞাসা করলাম, কেউ কোনো তথ্য পাচ্ছেন কি না। ইউটিউবের আপডেটগুলোও পুরোনো। ফলে বাংলাদেশে সেই মুহূর্তে কী ঘটছিল, তা জানার কোনো উপায় ছিল না।

দেশের সব কটি গণমাধ্যম বাইরের দুনিয়ায় ‘ব্লাকআউট’ থাকার কারণে আমার মতো প্রবাসীদের কাছে সময়টা যে অনেকটা কালরাত্রির শামিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। দেশটাকে আমরা কতটা ভালোবাসি, তা মনে করিয়ে দিচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হাজারো প্রবাসীর দেওয়া স্ট্যাটাসগুলো।

ইন্টারনেটের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় শুধু দেশের খবর থেকেই বঞ্চিত হইনি, প্রিয়জন ও পরিবারের সঙ্গেও যোগাযোগ করতে পারিনি আমরা। এমনকি আন্তর্জাতিক ফোনকলও এ সময় অনেকটা অচল ছিল। ফলে একেকটা দিন আমাদের কাছে হয়ে উঠেছিল ভয়ার্ত একেকটি রাত।

কোটা সংস্কারের দাবিতে বৃহস্পতিবার দিনের বেলায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সাংঘর্ষিক রূপ নেওয়ার পর যে রক্তপাত, বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীদের আর্তনাদ, পুলিশের মারমুখী অবস্থান, বিভিন্ন স্থাপনায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের প্রেক্ষাপটে আমাদের প্রবাসীদের মনে কেবলই শঙ্কা বেড়ে চলে। মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে, এমন শঙ্কাও ছিল।

বিশ্বের সঙ্গে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে আমার মতো হাজারো প্রবাসীর মনে বাংলাদেশকে ব্ল্যাকআউট করে রাখার যে কৌশল ক্ষমতাসীন সরকার নিয়েছিল, তা শুধু নিন্দনীয়ই নয়, মানবাধিকার লঙ্ঘনও। যদিও সরকার বলছে যে ডেটা সেন্টারে আন্দোলনকারীদের হামলার কারণে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়, কিন্তু পরিস্থিতি বিবেচনায় বিষয়টার সত্যতা কারও কাছে আসলে অস্পষ্ট নয়।

এই পাঁচ দিনের মতো দম বন্ধ হয়ে ওঠা সময় আর যেন আমাদের জীবনে না আসে। মনে রাখতে হবে যে দেশটার নতুন প্রজন্ম একধরনের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ, বারুদ। ওরা দেশটার ইতিবাচক পরিবর্তন চায়, যে পরিবর্তন আপনি–আমিও চাই। ওদের উপেক্ষা করে লাশের ওপর দাঁড়িয়ে আপনি সুখবার্তা দিতে পারেন না, পারবেন না।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেসব মানুষের কাছ থেকে দেশ নিয়ে কোনো কথাবার্তা তেমন একটা পাই না, সেই সব প্রবাসীও দেশ নিয়ে ভাবছেন, লিখছেন, ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। হ্যাশট্যাগে ইলন মাস্কের স্টারলিংককে টানছেন, যাতে করে দেশে স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সংযোগ স্থাপিত হয়। কোথাও শেয়ার হচ্ছে গণভবন দখলের কথা, কোথাও বলা হচ্ছে যে প্রধানমন্ত্রী পালিয়ে গেছেন, কোথাও বলা হচ্ছে দেশের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে সেনাবাহিনী। কোনটা সত্য, কোনটা মিথ্যা, কিছুই বোঝার সুযোগ ছিল না।

ঠিক এমন এক সময়ে আমরা খবর পেলাম যে ঢাকা থেকে বিবিসি বাংলা সরাসরি আপডেট দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো ভারতের ব্যুরোদের দিয়ে খবর পরিবেশন করছে। যুদ্ধ–যুদ্ধ আবহের এই সব খবর হঠাৎ আমাদের একাত্তরের রেডিও বার্তাগুলোর কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। যখন মানুষের কাছে ইন্টারনেট ছিল না, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ছিল না, কিন্তু তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজেদের এককাতারে আনতে রেডিও খবরকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন।

আজ এই সংকটময় সময়ে আমরাও তেমন বিবিসি বাংলার দেওয়া খবরের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। তাতে দেশে কী ঘটছে, তা নিয়ে একটি ধারণা পাওয়া গেলেও প্রিয়জনদের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যর্থ চেষ্টা আমাদের মনে খারাপ লাগা তৈরি করছিল, যা কখনো ভোলার নয়।

অনেকের নিকটাত্মীয় মারা গেছেন, তাঁর কোনো খবর নেওয়া সম্ভব হয়নি। কেউ কেউ সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর খবর জানতে পারেননি। বিদেশের মাটিতে প্লেন থেকে নেমে পরিবারকে জানাতে সক্ষম হননি। এমন এক পরিস্থিতিতে গত পাঁচ দিন ছিলেন প্রবাসীরা।

ফেসবুকের বন্ধুদের একটি বড় অংশ বাংলাদেশের হওয়ায় তাঁদের কোনো আপডেট বা স্ট্যাটাস না পাওয়ায় ফেসবুকটাও অসাড় হতে লাগল। সরকারকে দীর্ঘদিন ধরে সমর্থন দেওয়া অনেক মানুষকে দেখলাম, সরকারের কার্যক্রমকেই তুলাধোনা করছেন। এই ক্ষোভ দেখার পর মনে হচ্ছিল, দেশটার বাইরে থাকা প্রবাসীরা কতই না ক্ষোভ পুষে রেখেছিলেন, যা সময়ের পরিক্রমায় উগরে দিচ্ছেন। এসব দেখার সুযোগ অন্তত গত পাঁচ দিনে হয়েছে।

কোটা সংস্কারের দাবিতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মনোভাব বুঝতে ব্যর্থ হওয়া সরকারপক্ষ আজকের এই রক্তপাতের জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দায়ী থাকবে। ইতিহাস আমাদের রাষ্ট্রের এই ব্যর্থতার দায় নেবে না। অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার জন্য সরকার কখনোই আন্দোলকারীদের কাঁধে দায় দিতে পারবে না। সরকার চাইলেই শুরুতেই শিক্ষার্থীদের দাবির বিষয়টি যৌক্তিকভাবে সুরাহা করতে পারত। সময় নিয়ে হলেও অন্তত শিক্ষার্থীদের আশ্বস্ত করতে পারত। তা করতে পারলে হয়তো আমাদের এত লাশের মিছিল দেখতে হতো না। সাধারণ শিক্ষার্থীদের হাত ঘুরে আন্দোলন পাড়া-মহল্লা পর্যন্ত চলে যেত না।

মাতৃভূমিকে কতটা ভালোবাসা যায়, তা আমার মতো প্রবাসে যাঁরা বসবাস করেন, তাঁরা ভালো করে জানেন। দেশের সামান্য ব্যথায় যে আমার ব্যথিত হই, তা বোঝানো কঠিন। স্মরণকালের ভয়াবহ সংকটে পড়া প্রিয় মাতৃভূমি ঠিক কতটা ক্ষত সেরে উঠবে তা জানি না, তবে আধুনিক এই প্রযুক্তির জমানায় নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখতেও পারবে না।

জেন জি জেনারেশনের এই আন্দোলন যে কেবলই একটি আন্দোলন নয়, বরং দীর্ঘদিন ধরে চলা বৈষম্য ও অনাচারের বিরুদ্ধে বড় ধরনের প্রতিবাদ যাতে ‘সাধারণ মানুষ’ ক্রমেই জড়িয়ে পড়ছিল, তা এই আন্দোলনের মধ্যে স্পষ্ট হয়েছে। যদিও কোটা সংস্কারে আদালতের ৯৩ শতাংশ মেধার পক্ষে রায় এসেছে, মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের জন্য ৫ শতাংশ রাখা হয়েছে। কিন্তু এর আগেই পরিস্থিতি এমন জায়গা চলে গেল, তা তো আমরা জানলাম।

এই পাঁচ দিনের মতো দম বন্ধ হয়ে ওঠা সময় আর যেন আমাদের জীবনে না আসে। মনে রাখতে হবে যে দেশটার নতুন প্রজন্ম একধরনের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ, বারুদ। ওরা দেশটার ইতিবাচক পরিবর্তন চায়, যে পরিবর্তন আপনি–আমিও চাই। ওদের উপেক্ষা করে লাশের ওপর দাঁড়িয়ে আপনি সুখবার্তা দিতে পারেন না, পারবেন না। এই সব হত্যাকাণ্ডের বিচার যেমন চাইছি, তেমনি এখানে যে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে রাষ্ট্রের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি করা হয়েছে, সেটি যদি কোনো পক্ষ তাদের রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টার জন্য করে থাকে, তাদের মস্তিষ্কের সুস্থতাও কামনা করছি।